ক্রোমাটো গ্রাফি আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “দ্রবণ ও দ্রাব্যতা” ইউনিট ৬ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
ক্রোমাটো গ্রাফি
ক্রোমাটোগ্রাফির প্রাথমিক ধারণা (Primary Concept of Chromatography)
অবিশুদ্ধ যৌগের মিশ্রণের পরিমাণ অনেক বেশি হলে সাধারণত আংশিক পাতন, আংশিক কেলাসন, বাষ্প পাতন ইত্যাদি পৃথকীকরণ কৌশল ব্যবহার করে যৌগের বিশোধন করা হয়। কিন্তু যদি মিশ্রণে প্রায় একই দ্রাব্যতাবিশিষ্ট দুয়ের অধিক কঠিন উপাদান উপস্থিত থাকে অথবা দুই বা ততোধিক তরল পদার্থের মিশ্রণ যাদের স্ফুটনাঙ্ক প্রায় একই, তাদেরকে এ পদ্ধতিতে পৃথক করা যায় না। এক্ষেত্রে ক্রোমাটোগ্রাফি পদ্ধতির সাহায্যে অতি অল্প পরিমাণ অবিশুদ্ধ মিশ্রণ হতে যৌগ উপাদানসমূহকে পৃথক করা যায় । ক্রোমাটোগ্রাফি শব্দটির অর্থ রং চিত্রণ (গ্রিক, Chroma অর্থ রং এবং Graphe অর্থ চিত্রণ)।
ক্রোমাটোগ্রাফিক কৌশল যে নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা হলো মিশ্রণের উপাদানসমূহ দুটি দশার মধ্যে বণ্টিত হয়ে পৃথক হয় যার একটি হলো স্থির দশা (Stationary phase) এবং অন্যটি হলো চলমান দশা ( Mobile phase)। স্থির দশা হলো কলাম অথবা প্লেটট অথবা পেপার এবং চলমান দশা হলো তরল বা গ্যাস যা স্থির দশার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। স্থির দশায় এবং চলমান দশায় মিশ্রণের উপাদানসমূহের অধিশোষণ এবং দ্রাব্যতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় যে উপাদানের অধিশোষণ ক্ষমতা সবচেয়ে কম সে উপাদান প্রথমে এবং যে উপাদানের অধিশোষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি সে উপাদান সবশেষে সচল মাধ্যম দ্বারা পৃথক হয়। যদি স্থির মাধ্যম কঠিন হয় তবে তাকে অধিশোষণ ক্রোমোটোগ্রাফি এবং স্থির মাধ্যম তরল হলে তাকে পার্টিশন (Partition) ক্রোমাটোগ্রাফি বলে ।
নিম্নলিখিত সাধারণ কয়েক প্রকার ক্রোমাটোগ্রাফিয় পদ্ধতি হলো-
(১) কলাম ক্রোমাটোগ্রাফি (Column Chromatography)
(২) পাতলা স্তর ক্রোমাটোগ্রাফি (Thin Layer Chromatography)
(৩) পেপার ক্রোমাটোগ্রাফি (Paper Chromatography)
(৪) গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি (Gas Chromatography)
কলাম ক্রোমাটোগ্রাফি (Column Chromatography) :
কলাম ক্রোমাটোগ্রাফিতে একটি পরিষ্কার শুষ্ক কলাম নিয়ে এর নিম্নাংশে 0.25 ইঞ্চি পুরুর গ্লাসউল দেওয়া হয়। এর পর শুকনা পাউডার আকৃতির স্থির দশার জন্য অধিশোষক হিসেবে অ্যালুমিনা (Al2O3) অথবা সিলিকা জেল দ্বারা কলাম পূর্ণ করা হয়। অতঃপর বিশ্লেষণযোগ্য যৌগের মিশ্রণকে সামান্য পরিমাণে সিলিকা জেল বা অ্যালুমিনার সাথে মিশ্রিত করে কলামের উপর অংশে যোগ করে এর উপরে পুনরায় সামান্য পরিমাণে গ্লাসউল বা তুলা দেওয়া হয়। অতঃপর সুবিধাজনক দ্রাবক (ইথার, অ্যালকোহল, বেনজিন ইত্যাদি) কলামের উপর হতে নিচের দিকে প্রবাহিত করা হয়। ফলে বর্ণযুক্ত যৌগের মিশ্রণটি স্থির মাধ্যমে নিচে নেমে
আসার সময় স্থির মাধ্যম কর্তৃক অধিক শোষিত যৌগটি পরে এবং কম শোষিত যৌগটি আগে নেমে আসে। এ সময় কলামে যৌগসমূহের পৃথক পৃথক বর্ণযুক্ত ব্যান্ড দেখা যায়। ক্রমাগত দ্রাবক প্রবাহের ফলে একটির পর একটি উপাদান কলাম থেকে দ্রাবকের সাথে গ্রাহক পাত্রে নেমে আসে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত দ্রাবককে ইলিউয়েন্ট (eluent) এবং গ্রাহক পাত্রের দ্রাবকসহ দ্রবকে ইলিউশন (elution) বলে । প্রাপ্ত ইলিউশনকে পাতন করে দ্রাবক এবং মিশ্রণের যৌগ উপাদানকে বিশুদ্ধরূপে পৃথক করা হয় ।
পেপার ক্রোমাটোগ্রাফি (Paper Chromatography)
পরস্পর আংশিকভাবে মিশ্রণীয় বা সম্পূর্ণভাবে অমিশ্রণীয় এমন দুটি দ্রাবকের প্রবাহের ফলে মিশ্রণের উপাদান যৌগকে পেপার ক্রোমাটোগ্রাফির সাহায্যে শনাক্তকরণ ও পৃথকীকরণ করা সম্ভব। কৈশিক ক্রিয়ার (Capillary action) মাধ্যমে দ্রাবক পেপার বেয়ে উপরে উঠার সাথে সাথে মিশ্রণের বিভিন্ন উপাদানের পেপারে অধিশোষণ আসক্তির বিভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে পৃথক হয়ে পড়ে।
একটি হোয়াটম্যান ফিল্টার পেপার (4″x12″) নিয়ে এর নিম্নাংশের 2″-3″ উপরে কৈশিক নল দ্বারা নমুনা মিশ্রণের ফোঁটা দিয়ে তা শুকিয়ে নেওয়া হয়। ফিল্টার পেপার পানি শোষণ করে যা স্থির মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সচল মাধ্যম হিসেবে মিশ্রণের যৌগের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে দ্রাবক নির্বাচন করা হয়। একটি ট্যাংকের তলদেশে একটি পাত্রে নির্বাচিত দ্রাবক রেখে পাত্রের উপর থেকে পেপার এমনভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যাতে ফিল্টার কাগজের শেষ প্রান্তের কিছুটা অংশ দ্রাবকে ডুবে থাকে কিন্তু নমুনার ফোঁটাযুক্ত অংশ কিছুটা উপরে থাকে।
যখন দ্রাবক উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং ফোঁটাযুক্ত অংশ অতিক্রম করে তখন এটি মিশ্রণের উপাদান যৌগসমূহকে উপরের দিকে বিভিন্ন গতিতে বহন করে নিয়ে যায়। দ্রাবকের সাথে এসব যৌগের উপরের দিকে প্রবাহের গতি সাধারণত দ্রাবকের পোলারিটি, অণুর আকার, যৌগের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে । দ্রাবক ফিল্টার পেপারের উপরের প্রান্তে পৌঁছালে কাগজটি বের করে নেওয়া হয়। নমুনার উপাদানসমূহের অবস্থান রাসায়নিক বা ভৌত উপায়ে শনাক্ত করা হয়। অতঃপর উপাদানসমূহের অবস্থান অনুসারে ফিল্টার কাগজ কেটে নিয়ে উপযুক্ত দ্রাবকের সাহায্যে যৌগসমূহ দ্রবীভূত করে পৃথক করা হয়।
R মান (Retardation factor value) :
দ্রব এবং দ্রাবকের আপেক্ষিক গতি বেগকে R, মান দ্বারা প্রকাশ করা হয়। উপাদান কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব এবং দ্রাবক কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্বের অনুপাতকে R বলে । অর্থাৎ,
R = ..উপাদান কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব/দ্রাবক কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব
ব্যবহার : পেপার ক্রোমাটোগ্রাফির সাহায্যে বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিডের মিশ্রণ হতে উপাদানসমূহ পৃথক করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন গ্লুকোজ, লিপিডসমূহ, হরমোনসমূহ পৃথকীকরণ ও শনাক্তকরণ করা হয়।
পাতলা স্তর ক্রোমাটোগ্রাফি (Thin Layer Chromatography) :
পাতলা স্তর ক্রোমাটোগ্রাফির (TLC) সাহায্যে অতি অল্প (minute quantities of mixtures) পরিমাণে মিশ্রণের উপাদানসমূহ পৃথক করা, শনাক্তকরণ সম্ভব। একটি গ্লাস প্লেটটের (5 × 20 cm) উপর পাতলা পুরুর (0-25 mm) আস্তরণ দেওয়া হয়। এই আস্তরণ সাধারণত সিলিকাজেল, অ্যালুমিনা বা সেলুলোজের হয়ে থাকে, যা শোষক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পানিতে শোষকের ফ্লরি (Slurry) তৈরি করে তা TLC প্লেটটের উপর ছড়ানো যন্ত্রের (Spreading device) সাহায্যে সমভাবে ছড়ানো হয়। প্লেটটকে এবার 120° সে. তাপমাত্রায় বৈদ্যুতিক ওভেনে শুকানো হয় ।
সাধারণত 1–2% মিশ্রণের দ্রবণ কৈশিক নলের সাহায্যে অথবা মাইক্রোসিরিঞ্জের (microsyringe) সাহায্যে প্লেটটের যেকোনো প্ৰান্ত থেকে 1.5–2 সে. উপরে ফোঁটা স্থাপন করা হয়। একটি ফোঁটা হতে অপর ফোঁটার দূরত্ব কমপক্ষে 1.0 সে.মি. হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্লেটের ফোঁটা শুকিয়ে গেলে প্লেটটকে দ্রাবক চেম্বারে সুবিধাজনক দ্রাবকে এমনভাবে রাখা হয় যেন মিশ্রণের ফোঁটা দ্রাবকের কিছুটা উপরে থাকে । যখন দ্রাবক ধীরে ধীরে পরিশোষক স্তর বেয়ে উপরে উঠতে থাকে তখন মিশ্রণের উপাদানগুলো পৃথক স্তরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যখন দ্রাবক প্লেটটের অংশ অতিক্রম করে তখন প্লেটটি দ্রাবক চেম্বার থেকে বের করে আনা হয় এবং উপযুক্ত দ্রাবক দ্বারা 8 ধৌত করে মিশ্রণের উপাদানসমূহ আলাদাভাবে পাতন করে সংগ্রহ করা হয়।
আরও পড়ুন…