খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ এ ভিনেগার আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “কর্মমুখী রসায়ন” ইউনিট ৭ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ এ ভিনেগার
ভিনেগার :
6-10% ইথানোয়িক এসিডের জলীয় দ্রবণকে ভিনেগার বলে। ভিনেগার একটি অত্যন্ত বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভস্। এটি বাজারে সিরকা নামেও পরিচিত। দামে খুবই সস্তা ও সহজলভ্য। এটি খাদ্যের গুণগত মানকে অপরিবর্তিত রাখে। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং অতি সহজেই পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। খাদ্যদ্রব্যে ভিনেগার যোগ করলে উপাদানের pH মান কমে যায়।
এ মান 5 থেকে 4 এর নিচে নেমে আসে। খাদ্যের pH মান 4.5 এর নিচে নেমে গেলে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা খাদ্যদ্রব্য কোনোভাবেই নষ্ট হয় না। তবে ঈস্ট ও মোল্ড এ pH মানেও বংশবিস্তার করতে পারে। অধিকাংশ অণুজীবের বংশবিস্তারের অনুকূল pH পরিসর 6.5–7.51
ভিনেগারের প্রকারভেদ :
উৎপাদনের উৎসের উপর ভিত্তি করে ভিনেগারকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় ।
১. সাদা পাতিত ভিনেগার : এ জাতীয় ভিনেগার রেকটিফাইট স্পিরিট থেকে উৎপাদন করা হয়। অ্যালকোহলের গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতীয় ভিনেগারকে উৎপাদন করা হয়। ঔষধ শিল্পে এর ব্যবহার খুবই ব্যাপক। রান্নার কাজেও সিরকা হিসেবে একে ব্যবহার করা হয় ।
২. মদ ভিনেগার : আঙ্গুরের রসের গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতীয় ভিনেগার উৎপাদন করা হয় । একে লাল মদ ভিনেগারও বলা হয়। উন্নত দেশে বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশে এর ব্যবহার খুবই ব্যাপক। বিভিন্ন ধরনের অ্যালকোহলীয় পানীয়তে এর ব্যবহার রয়েছে।
৩. ফলজাত ভিনেগার : বিভিন্ন ধরনের ফল বিশেষ করে আপেল, আনারস, কমলা, পাকা কলা, পেয়ারা প্রভৃতি থেকে অ্যালকোহলিক গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের ভিনেগার প্রস্তুত করা হয়। এটি খুবই উৎকৃষ্ট মানের ভিনেগার। এ ধরনের ভিনেগার খুবই স্বাদযুক্ত হয় ও বিশেষ সুবাস যুক্ত হয়। সব ধরনের সালাদ ও সসে এটি উত্তম সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে ।
৪. চাল ভিনেগার : এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে এ জাতীয় ভিনেগারের উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপক। এ দেশগুলোতে অধিক পরিমাণে ধান তথা চাল উৎপাদন হয় বলে এ ধরনের ভিনেগারের উৎপাদনও বেশি পরিমাণে হয়। এ জাতীয় ভিনেগার কিছুটা মিষ্টি স্বাদযুক্ত। এর বর্ণ শস্যদানার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। ঘরে বসেই অতি সহজ উপায়ে চালের গুঁড়া থেকে এ জাতীয় ভিনেগার প্রস্তুত করা যায় ।
৫. স্বাদ ও গন্ধযুক্ত ভিনেগার : এ জাতীয় ভিনেগার খেজুরের রস, তালের রস বা আখের রস থেকে উৎপাদন করা হয়। পরে ভিনেগারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ যেমন— ধনেপাতা, মৌরী, পুদিনা, লেবুপাতা, জাম্বুরার পাতা ইত্যাদি যোগ করা হয়। এ জাতীয় ভিনেগার প্রস্তুত করার পর ঐ মিশ্রণে প্রতি 100 mL এর মধ্যে 2 mL গোলাপজল মেশানো হয় ।
ভিনেগার প্রস্তুতি
(ক) আখের রস বা খেজুরের রস বা তালের রস থেকে ভিনেগার প্রস্তুতি
খেজুরের রসের ক্ষেত্রে সরাসরি খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। তালের রসের ক্ষেত্রে সরাসরি তালগাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ 1 রসকে সূক্ষ্ম ছাঁকনির সাহায্যে ছেঁকে কড়াইতে ধীরে ধীরে তাপ দিয়ে দ্রবণের = অংশ কমিয়ে ফেলা হয়। এ ঘন দ্রবণের মধ্যেও 10% 3 চিনি বর্তমান থাকে ।
ঘন দ্রবণকে ঠাণ্ডা করে এবং প্রায় 5 L পরিমাণ দ্রবণকে পরিষ্কার পাত্রে নেওয়া হয়। এ দ্রবণের মধ্যে 2-2.5 mL লঘু H2SO4 মিশ্রিত করা হয়। লঘু H2SO4 অবাঞ্ছিত ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে দেয় না। দ্রবণের মধ্যে 2 চা চামচ (NH4)2SO4 ও 2 চা চামচ (NH4)3PO4 যোগ করে দ্রবণকে একটি কাঠি দিয়ে ভালোমতো নাড়া হয়। এবার এ দ্রবণকে 25-30°C তাপমাত্রায় রেখে মিশ্রণের মধ্যে 1 চা চামচ ঈস্ট যোগ করে পুনরায় দ্রবণকে কাঠি দ্বারা নেড়ে, ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা দ্বারা ঢেকে পাত্রটিকে তোয়ালে দ্বারা তিন দিন ঢেকে রাখা হয়। এ সময় গাঁজন প্রক্রিয়া সক্ষ্ম হয়।
ফলে CO2 উৎপন্ন হয় এবং মিশ্রণের উপরিস্তরে ফেনার সৃষ্টি হয়। ঈস্ট থেকে ইনভারটেজ ও জাইমেজ নামক দুটি এনজাইম নিঃসৃত হয়। নিঃসৃত ইনভারটেজ রসের চিনিকে আর্দ্র বিশ্লেষিত করে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে পরিবর্তিত করে। জাইমেজ এনজাইম গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজকে বিয়োজিত করে ইথানল ও কার্বন ডাইঅক্সাইডে পরিণত করে।
এক্ষেত্রে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং প্রক্রিয়ার শেষে দ্রবণে প্রায় 10% ইথানল থাকে। এ অ্যালকোহলের দ্রবণ থেকেই আমরা ভিনেগারকে প্রস্তুত করব। বড় আকারের একটি কাঠের পিপা (কাঠ দ্বারা তৈরি গোলাকার পাত্র বিশেষ) সংগ্রহ কর। পিপার মুখে ও তলদেশে সচ্ছিদ্র তাক যুক্ত থাকে। ঐ তাক দুটির মাঝখানে ভিজা কাঠের গুঁড়া দ্বারা ভর্তি করা হয়।
অতঃপর এ গুঁড়ার মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি সহায়ক (NH4)2SO4 ও (NH4)3PO4 যোগ করে এর মধ্যে মাইকোডার্মা অ্যাসিটি নামক ব্যাকটেরিয়া যোগ করা হয়। এবার 10% ইথানলের জলীয় দ্রবণকে কাঠের পিপার উপর হতে নিচের দিকে সূক্ষ্ম ধারায় কাঠের গুঁড়ার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়।
একই সময় নিচের দিক হতে ছিদ্র পথে উপর দিকে বায়ু প্রবাহ চালনা করা হয়। এ সময় তাপমাত্রা 30–35°C হওয়াই বাঞ্ছনীয়। লঘু ইথানলের নিম্নমুখী স্রোত ও ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর প্রবাহ পরস্পর মিলিত হয় এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে ইথানল জারিত হয়ে ইথানোয়িক এসিডে পরিণত হয়।
এ বিক্রিয়াটি তাপোৎপাদী এবং ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিক ক্রিয়া ও বৃদ্ধির জন্য অনুকূল তাপমাত্রা 30–35°C। তাই তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন । উৎপন্ন ইথানোয়িক এসিড ও অপরিবর্তিত ইথানল পিপার তলদেশে জমা হয়। এ মিশ্রণকে পাম্পের সাহায্যে বের করে পিপার উপর হতে নিচের দিকে কাঠের গুঁড়ার ভিতর দিয়ে কয়েকবার চালনা করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় প্রচুর বায়ুপ্রবাহের প্রয়োজন পড়ে। বায়ুর অক্সিজেন জারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। O2 এর পরিমাণ কম হলে অসম্পূর্ণ জারণের কারণে ইথানোয়িক এসিডের পরিবর্তনে ইথানল উৎপন্ন হয়। এরূপে উৎপন্ন (6–10)% লঘু ইথানোয়িক এসিডকে সংগ্রহ করে ছেঁকে পরিষ্কার পাত্রে তিন মাসের জন্য অন্ধকার স্থানে রেখে দেওয়া হয়। একে এজিং করা বলে। এজিং এর সময় যত বেশি হয় ভিনেগারের গন্ধ ও স্বাদ তত ভালো হয় ।
পরীক্ষাগারে ভিনেগার প্রস্তুতি :
মূলনীতি : 99.9% বিশুদ্ধ ইথানোয়িক এসিড, যার বাণিজ্যিক নাম গ্লাসিয়াল অ্যাসিটিক এসিড। গ্লাসিয়াল অ্যাসিটিক এসিডকে পানিতে দ্রবীভূত করে 6–10% ইথানোয়িক এসিডের দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। এ দ্রবণই ভিনেগার। ভিনেগারের pH মান সাধারণত 2-3 এর মধ্যে সীমিত থাকে।
রাসায়নিক উপাদান : গ্লাসিয়াল অ্যাসিটিক এসিড ও পাতিত পানি ।
যন্ত্রপাতি : 100 mL আয়তনমিতিক ফ্লাস্ক, 2 ডিজিট ব্যালেন্স, ওয়াশ বোতল ও কাচের ফানেল ।
বর্ণনা : 100 mL আয়তনের আয়তনমিতিক ফ্লাস্কের মধ্যে 20–25 mL পাতিত পানি নেওয়া হয়। 2 ডিজিট ব্যালেন্সের সাহায্যে 8 g বা তার কাছাকাছি মানের ইথানোয়িক এসিড পরিমাপ করে নেওয়া হয়। আয়তনমিতিক ফ্লাস্কের মুখে ফানেল বসিয়ে পরিমাপ করা ইথানোয়িক এসিডকে ফ্লাস্কের মধ্যে যোগ করা হয়।
এবার ওয়াশ বোতল থেকে ধীরে ধীরে পাতিত পানিকে ফানেলের গা বেয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যোগ করা হয়। এভাবে যেন সব ইথানোয়িক এসিড আয়তনমিতিক ফ্লাস্কে চলে যায়। ফ্লাস্কের দ্রবণের আয়তন 100 mL দাগ পর্যন্ত পূর্ণ করে নেওয়া হয়। আয়তনমিতিক ফ্লাস্কের মুখে কর্ক এঁটে দেওয়া হয়। এবার লেভেল এঁটে তাতে ভিনেগার লিখে রাখা হয় এবং শতকরা পরিমাণ কত তা উল্লেখ করা হয়।
সাবধানতা : ল্যাবরেটরির সাধারণ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
মল্ট ভিনেগার প্রস্তুতি :
মূলনীতি : বার্লির বীজকে বা ভুট্টা বীজকে বা গমের বীজকে পানিতে 20–24 ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে দেওয়া হয়। পানি থেকে বীজকে তুলে এনে 15°C তাপমাত্রার নিচে কাপড়ের বা চটের মধ্যে রেখে সূর্যের আলো কম পড়ে এমন স্থানে ঢেকে রাখা হয়। ফলে বীজ অঙ্কুরিত হয়। ফলে এর থেকে একটি সক্রিয় এনজাইম নিঃসৃত হয়। এ এনজাইম বার্লির বীজের স্টার্চকে ডাইজেস্ট করে চিনিতে পরিণত করে এবং যা শেষে মল্টেজে পরিবর্তিত হয়। একে মল্ট বলে। মল্ট থেকে যে ভিনেগার প্রস্তুত করা হয় তাকে মল্ট ভিনেগার বলা হয় । মল্টকে ভালোমতো পেষণ করে পেস্টে পরিণত করা হয়।
পেস্টের মধ্যে প্রয়োজনীয় পানি যোগ করে ঘন দ্রবণে পরিণত করা হয় । এ ঘন দ্রবণকে ছেঁকে নেওয়া হয়। ঘোলাটে দ্রবণকে মাটির পাত্রের মধ্যে রেখে 20–25°C তাপমাত্রায় স্থির রেখে ঈস্ট যোগ করে তিন দিন রেখে দেওয়া হয়। ঈস্ট থেকে মল্টেজ এনজাইম ও জাইমেজ এনজাইম নিঃসৃত হয়। এ মল্টেজ ও জাইমেজ এনজাইম গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোল্ডকে ইথানলে পরিণত করে। এ ইথানল অ্যাসিটো ব্যাকটর বা মাইকোডার্মা অ্যাসিটি নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে বায়ুর O2 দ্বারা জারিত হয়ে ইথানোয়িক এসিডে পরিণত হয়।
ভিনেগারের খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের কৌশল
বিভিন্ন ধরনের অণুজীব খাদ্যবস্তুকে খেয়ে ফেলে। খাদ্যের মধ্যে বসবাস করে বংশবিস্তার করে। অধিকাংশ অণুজীবের বংশবিস্তারের অনুকূল pH পরিসর 6.5–7.5। যদি খাদ্যের pH পরিসর 4.5 অপেক্ষা কম হয় তবে সেক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য ব্যাকটেরিয়া দ্বারা নষ্ট হয় না । তবে ঈস্ট ও মোল্ড এ pH পরিসরে বংশবিস্তার করতে পারে। ভিনেগার, 6–10%(w/v) CH3COOH এর জলীয় দ্রবণ। CH3COOH খুবই দুর্বল এসিড এবং এর বিয়োজন ধ্রুবক (Ka) এর মান 1-8 × 10”। পরীক্ষা করে দেখা যায় CH3COOH এর 6%(w/v) জলীয় দ্রবণের pH মান প্রায় 2-35 যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য খুবই কার্যকরী অবস্থা।
ভিনেগার যোগ করার ফলে খাদ্যদ্রব্যের pH মান দ্রুত কমে যায় এবং এ মান 4 এর নিচে নেমে আসে। খাদ্যদ্রব্যের উপর ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা আর থাকে না। উপরন্তু ভিনেগারের CH3-COOH খাদ্যের ব্যাকটেরিয়া ও ঈস্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। CH3-COOH দুর্বল এসিড হওয়ায় খাদ্যবস্তু সংরক্ষণের সময় খাদ্যকণার চারদিকে একটি পাতলা আবরণ সৃষ্টি করে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকে প্রতিহত করে। এ প্রক্রিয়াকে পিকলিং বলা হয় ।
ভিনেগার দ্বারা খাদ্য সংরক্ষণের সময় যদি খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পরিমাণমতো খাদ্য লবণ (NaCl) ও চিনি যোগ করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে ভিনেগারের কার্যকারিতা আরও অধিক হয়। কারণ লবণ ও চিনি খাদ্যদ্রব্য থেকে পানি শোষণ করে নেয়। যে কারণে ভিনেগারের ঘনমাত্রা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না । খাদ্যদ্রব্যে যুক্ত ভিনেগারের অবিয়োজিত CH3-COOH অণুজীবের দেহকোষের দেয়াল অতিসহজে অতিক্রম করতে পারে। অণুজীবের দেহের সাইটোপ্লাজমের উপস্থিতিতে CH3COOH এর বিয়োজন দ্রুত সম্পন্ন হয় ।
CH3 – COOH → CH 3 – COO + H’.
অণুজীবের সাইটোপ্লাজমে H’ আয়নের ঘনমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এর অভ্যন্তরীণ pH মান কমে যায়। ফলে অণুজীবের দেহের এনজাইম সিস্টেম ভেঙ্গে যায়। পরিণামে অণুজীবের কোষের মৃত্যু ঘটে। CH3 – COO আয়নটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা রাখে। ফলে খাদ্যের অণুজীব দ্বারা আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও খাদ্যের মধ্যকার এনজাইমঘটিত গাঁজন ক্রিয়া বন্ধ করে খাদ্যকে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। প্রকৃতপক্ষে খাদ্যদ্রব্যে ভিনেগার যোগ করার ফলে খাদ্যের pH মানের হ্রাস ঘটার কারণে খাদ্যে উৎপন্ন এনজাইম তার গঠন কাঠামো পরিবর্তন করে।
যখন এনজাইমের গঠন নির্দিষ্ট থাকে তখন তা খাদ্যদ্রব্যকে ভেঙে চিনি, চর্বি ও অন্যান্য প্রোটিনে পরিণত করতে কম শক্তির প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ভিনেগারের এসিডের কারণে খাদ্যের pH মান কমে যাওয়ায় এনজাইমের গঠন কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। ফলে এনজাইমের জৈবিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরও অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় । ফলে এনজাইমের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘস্থায়ীভাবে সুরক্ষিত হয়। ভিনেগারের মধ্যের CH3- COOH জলীয় দ্রবণে দ্রবীভূত হয়ে সর্বত্র সুষম ঘনমাত্রা বজায় রেখে অণুজীবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শিশুসহ যেকোনো বয়সের মানুষের শরীরে এর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। তাই ভিনেগারের সাহায্যে ফল, শাকসবজি, মাছ, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে এর ভূমিকা অপরিসীম।
খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে ভিনেগারের গুরুত্ব (Importance of Vinegar in Food Preservation)
খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের পর খাদ্যের নিরাপত্তার প্রশ্নে সবার আগে চলে আসে অণুজীবের আক্রমণের ফলে খাদ্যদ্রব্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। আমাদের খাবার অণুজীবের পুষ্টির উৎস। অণুজীবগুলো খাদ্য গ্রহণ করে মারাত্নকভাবে বংশবিস্তার করে খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ, পুষ্টিগুণ, বর্ণ ও সুঘ্রাণ নষ্ট করে খাদ্যকে খাবার অনুপযোগী করে দেয়। খাদ্যদ্রব্যকে সুরক্ষার জন্য দুটি প্রধান পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন । প্রথমত, অণুজীবের বিকাশ ও বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করা । দ্বিতীয়ত, অণুজীবের এনজাইমের কার্যকারিতা বিনষ্ট করে দেওয়া।
ভিনেগারের মধ্যে 6–10% (w/v) CH 3 – COOH থাকে। CH3 – COOH খুবই দুর্বল প্রকৃতির এসিড হওয়ায় এর বিয়োজন মাত্রাও খুব কম। 6%(w/v) CH3 – COOH এর ক্ষেত্রে – CH3 – COOH এর বিয়োজন ধ্রুবক (Ka) এর মান 1-8 × 105 ধরে নিলে শতকরা বিয়োজনের পরিমাণ মাত্র 42-43 × 102। ফলে ভিনেগারের উপস্থিতিতে খাদ্যদ্রব্য অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। খাদ্যের pH মান 4 এর নিচে নেমে যায়। বেশির ভাগ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াই এসিডীয় পরিবেশে টিকে থাকতে পারে না।
খাদ্য দ্রব্যকে সংরক্ষণের সময় যখন কৌটাজাত করা হয় তখন ব্রাঞ্চিং, একজসটিং, সিলিং ও স্টেরিলাইজিং করার সময় বেশির ভাগ অণুজীব মরে গেলেও ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম অণুজীব ধ্বংস হয় না। কারণ এটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় এ অণুজীবটি অন্যান্য অণুজীবের উপস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না। যেহেতু কৌটাজাতকৃত খাদ্যদ্রব্যে অন্যান্য অণুজীবগুলো মরে যায় সেজন্য এরা সহজেই বংশবিস্তার করে বেড়ে ওঠে। ভিনেগারের উপস্থিতিতে এ বেড়ে ওঠা সম্ভব হয় না। ভিনেগার শুধু বটুলিনাম নয় এটা স্যালমোনেলা, লিস্টেরিয়া এবং স্ট্যাফাইলোকক্কাস এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মূলত ব্যাকটেরিয়া অন্যান্য জীবাণু থেকে বেশি অম্লীয় পরিবেশে টিকে থাকলেও ভিনেগারের উপস্থিতিতে এটা টিকে থাকার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে ।
i. মাছ-মাংস সংরক্ষণে ভিনেগার : মাছ-মাংস একটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য কিন্তু এটি নির্দিষ্ট সময় পর অতি সহজেই অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। শুধু অণুজীব কেন বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলেও মাছ-মাংস নষ্ট হয়ে যায়। যেমন— মাছ-মাংসে উপস্থিত তেল ও চর্বির জারণ ক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলো নষ্ট হয়ে টক স্বাদ ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়। মাছ-মাংসকে ভিনেগারের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করলে এগুলো অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয় না এবং এর পুষ্টি মানেরও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। ভিনেগারের সাহায্যে মাছ-মাংসকে দীর্ঘ সময় মানসম্মত রেখে সংরক্ষণ করা যায়। এর ফলে মাছ-মাংসের সঠিক বর্ণও অপরিবর্তিত থাকে । মাছ-মাংস কৌটাজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রিজারভেটিভস্ হিসেবে ভিনেগারের ব্যবহার অপরিসীম।
ii. ফল সংরক্ষণে ভিনেগার : বিভিন্ন মৌসুমি কাঁচা ও পাকা ফল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভিনেগারের গুরুত্ব কম নয়। সারা বছর মৌসুমি ফলকে সহজে পাওয়ার জন্য অবশ্যই একে প্রিজারভেটিভস্ দ্বারা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয়। এতে উৎপাদনকারী যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় তেমনি ভোক্তারাও সারা বছর কম দামে এটি পেতে পারে। দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় অনেক মৌসুমি ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ভিনেগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
iii. শাকসবজি সংরক্ষণে ভিনেগার : শাকসবজি দ্রুত পচনশীল। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদিত হয়। একে টাটকা ও পুষ্টিমান সম্পন্ন রাখার ক্ষেত্রে প্রিজারভেটিভস্ হিসেবে ভিনেগারকে ব্যবহার করা যায়। ভিনেগারে শাকসবজি সংরক্ষণ করলে এর বর্ণ ও পুষ্টি মান অক্ষুণ্ণ থাকে। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একে ব্যবহার করা যায় ।
iv. রোগ প্রতিরোধে ভিনেগার : খাদ্যদ্রব্যে ভিনেগারের উপস্থিতি খাবারের রুচি বৃদ্ধি করে, রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়, হজম শক্তি বাড়ায়, শরীরে উৎপন্ন তরল অপদ্রব্য নিঃসরণ সহজ করে দেয়, রক্তের অপ্রয়োজনীয় চর্বি বিদূরিত করে শরীরকে পিম রাখতে সাহায্য করে। সম্প্রতি পরীক্ষায় প্রমাণিত যে, ভিনেগার রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টরলের পরিমাণ হ্রাস করে। ভিনেগার সমৃদ্ধ খাবার খেলে ক্যানসার ও টিউমার প্রতিরোধে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় ।
আরও পড়ুন…