খাদ্য নিরাপত্তা ও রসায়ন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “কর্মমুখী রসায়ন” ইউনিট ৭ এর অন্তর্ভুক্ত।
খাদ্য নিরাপত্তা ও রসায়ন
খাদ্য নিরাপত্তা ও রসায়ন (Food Security and Chemistry)
তিনটি মৌলিক বিষয়ের সাথে মূলত খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি সম্পর্কিত। এগুলো হলো- (১) খাদ্যের পর্যাপ্ততা, (২) খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং (৩) খাদ্যের সঠিক ব্যবহার।
১। খাদ্যের পর্যাপ্ততা : মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য একটি অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু। খাদ্য ব্যতীত কোনো জীব বাঁচতে পারে না। মানুষ তার প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রাণিকুল থেকে যেসব খাদ্য মানুষ গ্রহণ করে সেগুলোকে প্রাণিজ খাদ্য বলে। যেমন : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ প্রভৃতি প্রাণিজ খাদ্যের উদাহরণ। অন্যদিকে উদ্ভিদকুল থেকে যেসব খাদ্য মানুষ গ্রহণ করে সেগুলোকে উদ্ভিজ্জ খাদ্য বলে। যেমন— শস্যদানা, ফল, শাকসবজি, তেল, চিনি প্রভৃতি উদ্ভিদজাত খাদ্য ।
প্রাণিজ খাদ্যের পর্যাপ্ততা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। বিশেষ করে মাছ এবং মুরগির চাষ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে করা একান্তভাবে প্রয়োজন। পুকুর, খাল, বিল, হাওর, নদী-নালা প্রভৃতি স্থানে মাছ চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে পুকুরে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করা হয়। তবে মাছের প্রজনন পর্যাপ্ত খাবার, রোগ নিরাময়, পুকুরের পরিচর্যা প্রভৃতি বিষয়ের উপর সুদৃষ্টি রাখলে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে ব্যাপকভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন। মুরগির খামারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি না করার কারণে এদের বিভিন্ন ধরনের রোগ লেগেই থাকে।
রাসায়নিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে যেমন- মুরগির সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং সুচিকিৎসার মাধ্যমে এদেরকে বিভিন্ন ধরনের রোগের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব এবং এদের উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয়, রোগের সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল প্রভৃতি প্রাণীর উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। যা প্রাণিজ খাদ্যের ঘাটতি ব্যাপকভাবে পূরণ করে এর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা যেতে পারে ।
উদ্ভিজ্জ খাদ্যের জন্য আমরা ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উদ্ভিদকুলের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদের খাদ্য, পুষ্টি, জন্ম, বেড়ে উঠা এবং পরিপক্বতা উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে সম্ভব। যেমন— উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত পানি, আলো, বাতাস এবং রোগ বালাই হতে রক্ষার জন্য কীটনাশক। রসায়ন এ বিষয়গুলো সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে সমাধান করে খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিয়ন্ত্রণ করছে। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত খাদ্য প্রস্তুত করছে।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টিসাধন, ফুল ও ফল ধারণ এবং পরিপক্বতার জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করে থাকে। মাটির উর্বরতা ক্ষমতা হ্রাস পেলে উদ্ভিদের পুষ্টিসাধন ঠিকমতো না হওয়ায় ভালো ফুল এবং ফল উৎপাদন করতে পারে না। এজন্য মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধিকল্পে জমিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়। ইউরিয়া, TSP, DAP, SP প্রভৃতি সার জমিতে প্রয়োগ করে উদ্ভিদের ফলন বাড়ানো সম্ভবপর হয়েছে। তা ছাড়া মাটির pH মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে মাটির অম্লীয় এবং ক্ষারীয় অবস্থা জেনে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মাটির pH 2.5 পর্যন্ত যাতে নেমে না আসে সেজন্য প্রয়োজনীয় সার বাছাই করে তা জমিতে প্রয়োগ করা অপরিহার্য কর্তব্য। এভাবে রসায়ন বিজ্ঞানের জ্ঞানকে আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণিজ খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে পারি।
মনে রাখবেন : খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জাতির জন্য মহাসুখবর – দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ম্বর। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ । ২০১৩–১৪ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত চালের পরিমাণ ৭.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রকাশিত রিপোর্ট হতে দেখা যায়, ২০১৩–১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইচ্ছা করলে ৩.৯৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল অর্থাৎ প্রায় ৪০ লাখ টন চাল রপ্তানি করতে পারত ।
২০০৫–৬ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ২৬.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন ।
২০০৮–৯ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩১.৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন ।
২০১১–১২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩৩.০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
২০১৩–১৪ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩৪-২৬৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
এ অর্থবছরে চালের উৎপাদন পূর্বের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। এর সাথে রয়েছে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন, কৃষিজমির আওতা সম্প্রসারণ, কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি ও কৃষি গবেষণা কাজে জোর দেওয়া। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশও শুধু চাল রপ্তানিকারক দেশ নয় স্থায়ী চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পাবে। দেশের কৃষি উৎপাদন আরও বাড়াতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে দশ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৩–২২ সাল পর্যন্ত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৪টি জেলা— সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠী, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সাবাজার জেলায় কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এ মহাপরিকল্পনায় পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, পানি ব্যবস্থাপনা উত্তরণের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন, ভূ-উপরিস্থ পানি কৃষি সেচে ব্যবহার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোল্ট্রি ও গরুর খামার স্থাপনে সহায়তা প্রদান করা ।
২। খাদ্যের সহজলভ্যতা : খাদ্যের সহজলভ্যতার উপর এর নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আবার খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এর পর্যাপ্ততা। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা খাদ্যের সহজলভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হবে খাদ্যের সহজলভ্যতাও তত বেশি হবে। সব ধরনের শস্য, ফলমূল এবং শাকসবজি দেশের সব অঞ্চলে সমহারে উৎপাদিত হয় না। দেশের কোনো অঞ্চলে ধান অধিকহারে উৎপন্ন হয় কিন্তু ফলমূল, শাকসবজি তেমন উৎপন্ন হয় না। আবার কোনো অঞ্চলে শাকসবজি, ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় কিন্তু ধান পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয় না।
যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয় তবে সুষ্ঠু পরিবহন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্যের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। রসায়ন বিজ্ঞান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরবরাহকৃত খাদ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ করতে না পারলে দ্রুত পচন ধরে এবং বিনষ্ট হয়। এগুলোর সুন্দর এবং সুষ্ঠু উপায়ে সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ রাসায়নিক পদার্থ প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করে খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব।
কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়া এবং নিরাপদ প্রিজারভেটিভ ব্যবহার জ্ঞান খাদ্যের সহজলভ্যতা তথা নিরাপত্তার জন্য রসায়ন বিজ্ঞান নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফরমালিন (ফরমালডিহাইডের ৪০% জলীয় দ্রবণ) ব্যবহার করে মাছ, সবজি- তরিতরকারি এবং ফল সংরক্ষণ করছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। সঠিক রাসায়নিক প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকার কারণে এবং অধিক মুনাফা লাভের আশায় এ অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। সঠিক প্রিজারভেটিভ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করলে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকা এ অভিশাপের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে পারে।
৩। খাদ্যের সঠিক ব্যবহার : শুধু খাদ্যের পর্যাপ্ততা এবং সহজলভ্যতা দ্বারাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি খাদ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন । এজন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি :
ক) খাদ্যের পুষ্টি জ্ঞান,
খ) বিশুদ্ধ উপকরণ ব্যবহার করে সঠিক নিয়মে খাদ্য রান্না করা,
(গ) খাদ্য গ্রহণে শারীরিক সক্ষমতা এবং
(ঘ) বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ।
(ক) খাদ্যের পুষ্টি জ্ঞান : একজন মানুষ কোন ধরনের খাবার কী পরিমাণ খাবে তা পুষ্টিবিজ্ঞানের আলোকে নির্ধারণ করা হয়। প্রতিদিনের খাবার গ্রহণের সময় লক্ষ রাখতে হবে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো উপাদান বাদ পড়ছে কিনা। এজন্য খাদ্যের গুণগতমান বিশ্লেষণ করে সুষম খাদ্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। রাসায়নিক বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন কোন খাদ্যে কী কী উপাদান কী পরিমাণে আছে তা নির্ধারণের জন্য রসায়ন বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
(খ) বিশুদ্ধ উপকরণ ব্যবহার করে সঠিক নিয়মে খাদ্য রান্না করা : খাদ্যদ্রব্য রান্না করার সময় যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলো বিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। পানি, লবণ, তেল, মসলা প্রভৃতি বিশুদ্ধ না হলে রান্না করা খাবার খেয়ে বিভিন্ন রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। খাবারের গুণগত মান সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় তাপ প্রয়োগের ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিক সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় খাদ্যদ্রব্য রান্না করলে খাদ্যের পুষ্টিমান বিনষ্ট হয়। রাসায়নিক প্রযুক্তিজ্ঞান এ বিষয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে ধারণা দিতে সক্ষম ।
(গ) খাদ্য গ্রহণে শারীরিক সক্ষমতা : শারীরিক সক্ষমতার আলোকে একজন মানুষের খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। অসুস্থ কোনো মানুষকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার দিতে হবে। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি নিয়ম বহির্ভূতভাবে খাবার গ্রহণ করে তবে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য শরীরের রোগ নির্ণয়, প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রস্তুত ও সেবনে রসায়ন বিজ্ঞান এক বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে।
(ঘ) বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ : পানির অপর নাম জীবন। জীবন ধারণের জন্য পানির কোনো বিকল্প নেই। তাই বলে সব জায়গায় পানি যেমন— সমুদ্রের লোনা পানি, জলাশয়ের পানি, কুয়ার পানি, পুকুরের পানি পান করা কি স্বাস্থ্য সম্মত? শুধু বিশুদ্ধ পানিই পান করতে হবে। দূষিত পানিতে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগের জীবাণু থাকে যা মানব জীবনের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। খাদ্য নিরাপত্তায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের পর তা হজমের জন্য পানির প্রয়োজন হয়। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ফিটকিরি, ফিল্টার, হ্যালোট্যাবের ব্যবহার রসায়নের গবেষণার সুফল।
আরও পড়ুন…