ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ও গ্লাসসামগ্রী পরিষ্কারক এবং ব্যবহারের নিরাপদ কৌশল আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার” ইউনিট ৮ এর অন্তর্ভুক্ত।
ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ও গ্লাসসামগ্রী পরিষ্কারক এবং ব্যবহারের নিরাপদ কৌশল
ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ও গ্লাসসামগ্রী পরিষ্কার করার কৌশল (Methods of Cleaning Laboratory, Apparatus and Glassware)
রসায়ন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাকার্য নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, টেস্টটিউব, কনিক্যাল ফ্লাস্ক, ব্যুরেট, পিপেট, মাপন ফ্লাস্ক ইত্যাদি পরিষ্কার হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষাকার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে প্রথমে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তবে ল্যাবরেটরির সকল যন্ত্রপাতি একই পদ্ধতিতে একই পরিষ্কারক দ্বারা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এজন্য ময়লা রাসায়নিক বস্তুর প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে দ্রাবক ও পরিষ্কারক নির্বাচন করতে হয়।
যেমন— পানিতে দ্রবণীয় ময়লা সাধারণ পানি ও ডিজারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পানিতে অদ্রবণীয় ময়লা বস্তু যেমন— গ্রিজ, তেল জাতীয় পদার্থ, অ্যাসিটোন বা ইথানল দিয়ে ধুয়ে পরে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কাচের তৈরি ব্যুরেট ক্রোমিক এসিড দ্রবণ (গাঢ় H2SO4 ও K2Cr2O7 এর দ্রবণ) ব্যবহার করা হয়। তবে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা কাজ শেষ করার সাথে সাথে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করলে সহজে পরিষ্কার হবে। পুরনো অপরিষ্কার যন্ত্রপাতিতে ময়লা শুকিয়ে গেলে বা জমে গেলে সেগুলো দূর করার জন্য যন্ত্রপাতি গরম পানিতে ফুটিয়ে নিতে হয়।
কাচ সামগ্রী থেকে লুব্রিকেন্ট গ্রিজ অপসারণ কাজে সোডিয়াম কার্বনেটের লঘু দ্রবণে কাচ সামগ্রীকে ডুবিয়ে কিছুক্ষণ উত্তপ্ত করা হয়। সিলিকন গ্রিজ দূর করতে কাচ সামগ্রীকে ডেকাহাইড্রো ন্যাফথালিনে ডুবিয়ে দুই ঘণ্টা হালকা তাপ দিতে হয়। এছাড়াও আলকাতরা জাতীয় পদার্থ, গ্রিজ, সিলিকোন তেল দূর করতে ডেকন-৯০ ডিটারজেন্ট অত্যন্ত কার্যকর। লেড সালফেট অবশেষ অ্যামোনিয়াম অ্যাসিটেট দ্রবণে ডুবিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়।
ল্যাবরেটরিতে কাজ শেষ হয়ে গেলে টেবিলটি একটি কাপড়ের ডাস্টার দ্বারা মুছে পরিষ্কার করতে হবে। ব্যবহৃত কাচের দ্রব্য যেমন— বিকার, টেস্টটিউব, কনিক্যাল ফ্লাস্ক ইত্যাদি ব্রাশের সাহায্যে প্রথমে পানি ও পরে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে শেষে পুনরায় পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে রাখতে হবে। শুকানোর প্রয়োজন হলে ওভেনে (40–50°C তাপমাত্রায়) রাখতে হবে।
ব্যুরেট পরিষ্কারের জন্য লম্বা ব্রাশ পাওয়া যায়। এর সাহায্যে অ্যাসিটোন বা অ্যালকোহল দিয়ে পরিষ্কার (Rinse) করতে হবে এবং ব্যুরেট স্ট্যান্ডে খাড়াভাবে ক্লাম্পের সাথে আটকিয়ে রাখতে হবে। পিপেট পরিষ্কার পানি দিয়ে বার বার ধুতে হবে। প্রয়োজনে অ্যাসিটোন দিয়ে রিন্স (Rinse) করা যেতে পারে। অন্যান্য যন্ত্রপাতি যেমন— সেন্ট্রিফিউজিং মেশিন, ওয়াটার বাথ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে কোনো ময়লা বা রাসায়নিক দ্রব্য পড়লে তা ডাস্টার/কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
গ্লাসসামগ্রী ব্যবহারের নিরাপদ কৌশল (Safe Use of Glass Apparatus)
রসায়ন পরীক্ষাগারে বহু ধরনের গ্লাসসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে বিকার, ব্যুরেট, পিপেট, কনিক্যাল ফ্লাস্ক, গোলতলি ফ্লাস্ক, পরীক্ষানল ইত্যাদি প্রধান। এগুলোর ব্যবহার সম্বন্ধে এই অধ্যায়ের অন্যান্য অংশে আলোচনা করা হয়েছে। গ্লাস নির্মিত যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং ভেঙে গেলে ছুরির মতো ধারালো টুকরায় পরিণত হয়। তাই ল্যাবরেটরিতে নিরাপদে গ্লাসসামগ্রী ব্যবহারের সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

১. কাচের তৈরি গ্লাসসামগ্রী সব সময় পরিষ্কার রাখতে হয়।
২. গরম অবস্থায় খালি হাতে কখনো কোনো গ্লাসসামগ্রী ধরা উচিত নয়।
৩. যেদিকে পানির ট্যাপ বা বেসিন/সিঙ্ক থাকে সেদিকে কোনো গরম কাচের পাত্র রাখা ঠিক নয়। কারণ গরম কাচের পাত্রে পানি পড়লে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. ব্যুরেট বা পিপেটে কখনো তাপ দিতে হয় না। কারণ এ দুটোর সাহায্যে মাত্রিক বিশ্লেষণ করা হয়। তাপ দেওয়ার ফলে এদের আয়তনের পরিবর্তন হতে পারে ।
৫. সিন্টার্ড গ্লাস ক্রসিবল, পোর্সেলিন বেসিন, প্রয়োজনে লঘু হাইড্রোক্লোরিক এসিড দ্বারা পরিষ্কার করে পরবর্তীতে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধুয়ে ওভেনে শুকানোর জন্য রাখা হয়। টেবিলের উপর রাখার সময় যেন একটার সাথে একটার ধাক্কা লেগে ভেঙে না যায় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৬. এক স্থান হতে অন্য স্থানে নেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ভেঙে না যায় ।
৭. ভারী বোতল বা এসিডের বোতলের শুধু গলা না ধরে নিচে হাত দিয়ে ধরতে হয়। নচেৎ কোনো কারণে পড়ে ভেঙে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ।
৮. কাচ পাত্রে কোনো জিনিস গরম করতে গেলে প্রথমে মৃদু তাপে আস্তে আস্তে ও পরে তাপমাত্রা বাড়িয়ে উচ্চতাপে তাপ দিলে পাত্রটি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় ।
৯. ডেসিকেটরের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি থাকে এবং এটি অপেক্ষাকৃত ভারী হয়। যার জন্য এক স্থান হতে অন্য স্থানে সাবধানে নিতে হয় এবং এর মুখে গ্রিজ লাগিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করতে হয়।
১০. এছাড়া অন্য কাচপাত্র যেমন— ফানেল, বিন্দুপাতি ফানেল, থিসল ফানেল, পাতন ফ্লাস্ক, মাপন ফ্লাস্ক ইত্যাদি খুব ঠুনকো ধরনের । এটা খুব সাবধানে ব্যবহার না করলে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।
১১. গ্লাসসামগ্রী ধোয়ার সময় পানির ট্যাপে বা বেসিনে যেন আঘাত না লাগে ৷
১২. টেস্টটিউব ব্যবহারের সময় হোল্ডার ব্যবহার করতে হবে। হোল্ডারে টেস্টটিউব ফিটিংকালে বেশি চাপ দেওয়া যাবে না ।
১৩. কাচ সামগ্রী প্লাস্টিক বা রাবার টিউবিং ঢোকাতে হলে টিউবের প্রান্তকে গ্রিজ বা গ্লিসারিন দ্বারা পিচ্ছিল করে নিতে হবে। এছাড়া গোলতলি ফ্লাস্কের মুখের আকারের সাথে সংগতিপূর্ণ শীতক, স্টপার লাগাতে হবে এবং কাজ শেষে খুলে মুছে বা ধুয়ে রাখতে হবে। তা না হলে শীতক ফ্লাস্কের মুখে স্থায়িভাবে লেগে যেতে পারে।
১৪. স্ট্যান্ডে ব্যুরেট আটকানোর সময় আলতোভাবে ক্ল্যাম্পের সাথে এমনভাবে লাগাতে হবে যেন ব্যুরেট উঠানামা না করে ।
আরও পড়ুন…