পরিবেশের উপর ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব ও পরিমিত ব্যবহারের গুরুত্ব আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার” ইউনিট ৮ এর অন্তর্ভুক্ত।
পরিবেশের উপর ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব ও পরিমিত ব্যবহারের গুরুত্ব
রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নিয়মগুলো অনুসরণ
(i) রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করার সময় নির্দেশনা অনুযায়ী রাসায়নিক দ্রব্য নিতে হবে বা যুক্ত করতে হবে । প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নিলে বিক্রিয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হবে, বিকারকের অপচয় হবে ও অতিরিক্ত বর্জ্য সৃষ্টি হবে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম নিলে বিক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে না ।
(ii) পরীক্ষাগারে ব্যবহারের জন্য ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষক বা গবেষণাগারের পরিচালক মূল বোতল হতে রাসায়নিক দ্রব্য বিকারে বা কোনো পাত্রে ঢেলে দেবে।
(iii) কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পূর্বে তার MSDS থেকে ঐ পদার্থের উৎপাদন তারিখ, মেয়াদ, ঝুঁকি ও ঝুঁকির মাত্রা, হ্যাজার্ড চিহ্ন ইত্যাদি ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। প্রয়োজনে শ্রেণিশিক্ষক রাসায়নিক পদার্থের ঝুঁকি সম্পর্কে ব্রিফিং দেবেন।
(iv) প্রতিটি রাসায়নিক উপাদান সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। কোনো রাসায়নিক পদার্থ হাত দিয়ে স্পর্শ করা, স্বাদ গ্রহণ বা গন্ধ নেওয়া যাবে না ।
(v) কোনো নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের জন্য আগে থেকে নির্দিষ্ট করা স্পেচুলা/পিপেট/ড্রপার/ গ্লাসরড ব্যবহার করতে হবে। এক বিকারকে ব্যবহৃত স্পেচলা/ পিপেট/ ড্রপার / গ্লাসরড অন্য বিকারকে ব্যবহার করা যাবে না ।
(vi) যখনই কোনো রাসায়নিক দ্রব্য বোতল বা পাত্র থেকে ব্যবহার করবে তার পর পরই ছিপি বা কর্ক দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে।
(vii) ব্যবহারের পূর্বে সঠিক রাসায়নিক দ্রব্য, দ্রব্যের সঠিক মান ও ঘনমাত্রা নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করবে।
(viii) ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ও উৎপাদিত রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব, ঝুঁকির মাত্রা, ঝুঁকি, সতর্ক সংকেত ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ix) স্টক বোতল থেকে ঢেলে নেওয়ার পর অতিরিক্ত অব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ পুনরায় স্টক বোতলে রাখা যাবে না ।
(x) বিষাক্ত, রাসায়নিকভাবে সক্রিয়, অনিরাপদ, বিস্ফোরণ বা হঠাৎ নির্গত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে, আগুন ধরতে পারে, পরিবেশ ও প্রাণীর ক্ষতিসাধন করে এরকম রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে।
ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপদ সংরক্ষণ ও পরিত্যাগ (Safe storage and disposal of chemicals used in labo ratory)
ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করার সময় যেমন দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন তেমনি কাজ শেষ করার পর ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য বা বর্জ্যের সংরক্ষণ ও পরিত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
নতুবা বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালিতে ছেড়ে দিলে পরিবেশ ও প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। এজন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থসমূহ ও বর্জ্যের ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনা করে বর্জ্যের শ্রেণিকরণ, সংরক্ষণ, বিশোধন, দ্রাবক পুনরুদ্ধার ও নিরাপদ পরিত্যাগের জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় অবলম্বন করতে হবে। ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে ।
১ . উৎপন্ন বর্জ্যকে পুনরুদ্ধারযোগ্য বর্জ্য, ক্ষতিকর বর্জ্য, সাধারণ বর্জ্য, প্রশমনযোগ্য বর্জ্য ইত্যাদি শ্রেণিকরণ করে বিভিন্ন পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। পাত্রের গায়ে প্রয়োজনে ঝুঁকি, ঝুঁকির মাত্রা, সতর্ক চিহ্ন, সংরক্ষণের তারিখ ইত্যাদি উল্লেখ করে MSDS লাগিয়ে দিতে হবে।
২. পুনরুদ্ধারযোগ্য বর্জ্যের জৈব দ্রাবক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ পুনরুদ্ধার করে পরে সৃষ্ট বর্জ্যকে পরিত্যাগের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে ।
৩. ব্যুরেটের অব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ (যেমন— NaOH, Na2CO3, KMnO4, K2Cr2O7, HCl ইত্যাদি) পুনরায় ব্যবহারের জন্য বিকারে সংরক্ষণ করতে হবে।
8. পরস্পর বিপরীতধর্মী বর্জ্য পৃথক পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। জারক পদার্থের সাথে কখনো দাহ্য তরল মিশ্রিত করা যাবে না । কারণ এতে আগুন ধরে যেতে পারে। কোনো অবস্থাই একই পাত্রে বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তু মিশ্রিত করে সংরক্ষণ করা যাবে না । এতে পরিত্যাগযোগ্য বিভিন্ন বস্তুর বিক্রিয়ায় বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন বা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
৫. Na, K, Li ইত্যাদি সক্রিয় ধাতু বর্জ্য হিসেবে উৎপন্ন হলে এসব বর্জ্য অ্যালকোহল যোগে সংরক্ষণ পাত্রে রাখতে হবে। বর্জ্য পাত্রগুলোকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
রাসায়নিক বর্জ্য পরিত্যাগের প্রক্রিয়া জটিল, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের সময় যেন কম পরিমাণে বর্জ্য সৃষ্টি হয় তার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাসায়নিক বর্জ্য পরিত্যাগের জন্য নিচের নিয়মগুলো অনুসরণ করা প্রয়োজন ।
১. সাধারণ নিরাপদ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্যকে দ্রুততম সময়ে পরিত্যাগ করতে হবে। এছাড়া সাধারণ তরল বর্জ্যকে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ধুয়ে সিংকে পরিত্যাগ করতে হবে।
২. এসিডীয় বর্জ্যকে Na2CO3 বা চুন দ্বারা প্রশমিত করে এবং ক্ষারীয় বর্জ্যকে NaHSO, দ্বারা প্রশমিত করে সিংকে অতিরিক্ত পানি প্রবাহে পরিত্যাগ করতে হবে।
৩. পুনরুদ্ধারযোগ্য বর্জ্যের জৈব দ্রাবক পাতন প্রক্রিয়ায় পুনরুদ্ধার করে বর্জ্য পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যান্য পুনরুদ্ধারযোগ্য রাসায়নিক পদার্থ পুনরুদ্ধারের পর বর্জ্য পরিত্যাগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. বিষাক্ত, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য ভূগর্ভস্থ বা ভূপৃষ্ঠের পানির উৎসে বা ফসলি জমিতে পরিত্যাগ করা যাবে না । প্রয়োজনে আলাদা গর্ত করে মাটি দিয়ে পলিথিনে ভরে বর্জ্যকে ঢেকে দিতে হবে।
৫. ধারক পাত্র পরিত্যাগের পূর্বে কয়েকবার ধুয়ে নিতে হবে।
৬. Li, Na, K ইত্যাদি সক্রিয় ধাতু অ্যালকোহলে (মিথানল বা ইথানল) বিক্রিয়া ঘটিয়ে নষ্ট করে পরিত্যাগ করা হয়। বিষাক্ত ধাতুর জলীয় দ্রবণ সোডিয়াম সালফাইড যোগে অধঃক্ষিপ্ত করে, H2O2 কে অম্লীয় FeSO4 যোগে, LiAIH, কে ধ্বংস করতে Na2SO4 বা MgSO4 ব্যবহার করা হয়। SO2, CO2, NO2 গ্যাসকে চুনের পানিতে শোষণ করে প্রশমিত করা হয়। অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থকে ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থে রূপান্তরিত করে পরিত্যাগ করা হয়।
আরও পড়ুন…