Site icon Chemistry Gurukul [ রসায়ন গুরুকুল ] GOLN

কেলাসন, পাতন ও দ্রাবক নিষ্কাশন

কেলাসন, পাতন ও দ্রাবক নিষ্কাশন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “দ্রবণ ও দ্রাব্যতা” ইউনিট ৬ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

কেলাসন, পাতন ও দ্রাবক নিষ্কাশন

কেলাসন (Crystallization)

প্রকৃতিতে প্রাপ্ত উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ জৈব যৌগ এবং অজৈব যৌগ বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। যেমন— প্ৰকৃতিতে প্রাপ্ত খাদ্য লবণ বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। এতে অতি সামান্য পরিমাণে CaCl2, MgCl2, MgSO4, Na2SO, প্রভৃতি দ্রবণীয় ভেজাল ছাড়াও অদ্রবণীয় ভেজাল হিসেবে বালি মিশ্রিত থাকে। তাই প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এবং ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত অবিশুদ্ধ যৌগসমূহ বিশুদ্ধ করার প্রয়োজন হয় ।

সাধারণত জৈব যৌগের বিশোধনে কেলাসন প্রণালি ব্যাপক ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ভৌত প্রণালি অর্থাৎ কোনো প্রকার রাসায়নিক বিক্রিয়া না ঘটিয়ে নির্দিষ্ট যৌগকে অপরিবর্তিত রেখে তা থেকে অন্যান্য মিশ্রিত পদার্থ পৃথক করা হয়।

কেলাসের সংজ্ঞা : কোনো কঠিন অবিশুদ্ধ বস্তুকে উপযুক্ত দ্রাবকে দ্রবীভূত করে উক্ত বস্তুর সম্পৃক্ত দ্রবণকে তাপ প্রয়োগে উত্তপ্ত করার পর ধীরে ধীরে শীতল করে অবিশুদ্ধ বস্তুকে বিশুদ্ধ কেলাসরূপে পৃথক করার পদ্ধতিকে কেলাসন বা স্ফটিকীকরণ বলে। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত যেসব দ্রাবক ব্যবহৃত হয় সেগুলো হলো পাতিত পানি, ইথানল, ইথার, এসিটোন, হেক্সেন, ডাইক্লোরোমিথেন, ক্লোরোফরম ইত্যাদি ।

বর্ণনা : প্রথমে এমন একটি দ্রাবক নির্বাচন করা হয় যাতে অবিশুদ্ধ কঠিন যৌগ সহজেই দ্রবীভূত হয়। দ্রাবকের উদ্বায়িতা যত কম হয় ততই ভালো। দ্রাবকে বিশোধন যৌগ যোগ করে সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করা হয়। এবার সম্পৃক্ত দ্রবণকে তাপ প্রয়োগ করে উত্তপ্ত অবস্থায় দ্রবণকে পরিস্রাবণ (ফিল্টার) করে অদ্রবণীয় বস্তু থেকে পৃথক করা হয়। ব্যবহৃত দ্রাবকটি খুব বেশি উদ্বায়ী হলে পাত্রের মুখে শীতক যুক্ত করতে হবে। এবার পরিস্রুত দ্রবণ কক্ষ তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকলে কেলাসন শুরু হয় এবং ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই পদার্থটি তার নিজস্ব আকৃতির বড় বড় কেলাসে পাত্রের তলায় জমা হয় ।

তবে দ্রবণ বরফ যোগে দ্রুত শীতল করলে পদার্থটির কেলাস মিহি আকারের হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিশ্র দ্রাবক ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে অধিক পোলার দ্রাবকে প্রথমে অবিশুদ্ধ পদার্থকে দ্রবীভূত করে সম্পৃক্ত দ্রবণ করা হয় অতঃপর দ্রবণটি তাপ দিয়ে ফিল্টার করার পর পরিসুত দ্রবণে ফোটায় ফোটায় কম পোলার দ্রাবক যোগ করা হয়। দ্রবণ ঘোলা হলে কক্ষ তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে শীতল করে পদার্থটিকে কেলাসিত করা হয়। এভাবে প্রাপ্ত কেলাসসমূহ ছেঁকে পৃথক করা হয় এবং সামান্য দ্রাবক দ্বারা ২/৩ বার ধৌত করে ছাঁকন কাগজ দিয়ে শুকানো হয় অথবা ডেসিকেটরে রেখে দিলে ৪/৫ ঘণ্টা পর শুষ্ক বিশুদ্ধ কেলাস পাওয়া যায়।

কেলাসন প্রক্রিয়ার প্রবাহ চিত্র :

পাতন (Distillation )

মূলনীতি : দুই বা ততোধিক তরল পদার্থের মিশ্রণ হতে তাপ প্রয়োগে মিশ্রণের উপাদানসমূহকে বাষ্পে পরিণত করে আবার সেই বাষ্পকে শীতল করে তরল আকারে পৃথক কারার প্রক্রিয়াকে পাতন বলে।

পাতন প্রক্রিয়ার সাহায্যে অনুদ্বায়ী কঠিন ও তরলের মিশ্রণ হতে উপাদানসমূহ পৃথক করা যায়। আবার দুই বা ততোধিক তরলের মিশ্রণ হতে উপাদান তরল যৌগকে পৃথক করা যায়। মিশ্রিত তরল যৌগের স্ফুটনাঙ্কের পার্থক্য যত বেশি হবে ততই এদের উপাদান পৃথক করা সহজ হয়।

বর্ণনা : একটি পাতন ফ্লাস্কে মিশ্রিত তরল যৌগ নিয়ে এর মুখে কর্কের সাহায্যে একটি থার্মোমিটার এমনভাবে যুক্ত করা হয় যেন এটির নিম্নাংশ ফ্লাস্কের পার্শ্বনলের মুখ বরাবর পৌঁছে। এবার পাতন ফ্লাস্কটিকে একটি তারজালির উপর বসিয়ে স্ট্যান্ডের সাহায্যে ভালোভাবে

যুক্ত করা হয়। ফ্লাস্কটির পার্শ্বনলের সাথে লিবিগ শীতক লাগিয়ে শীতকের পার্শ্বনল একটি পানির ট্যাপের সাথে যুক্ত করে পানির প্রবাহ চালনা করা হয়। শীতকের নিম্নপ্রান্তে গ্রাহক পাত্র যুক্ত করা হয়। এবার ফ্লাস্কটিতে তাপ প্রয়োগ করলে তরলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তরলের স্ফুটনাঙ্ক পৌঁছামাত্রই তরল বাষ্প হতে থাকবে এবং শীতকে প্রবেশ করে ঘনীভূত হয়ে আবার তরলে পরিণত হয়ে গ্রাহক পাত্রে জমা হবে। যতক্ষণ তরলটি বাষ্পে পরিণত হওয়া শেষ না হবে ততক্ষণ তরলের তাপমাত্রা স্থির থাকে ।

আংশিক পাতন (Fractional distillation) :

দুই বা ততোধিক তরল মিশ্রণ যার উপাদান তরলের স্ফুটনাঙ্কের পার্থক্য 40° সে. বা তার বেশি হলে সাধারণ পাতন প্রক্রিয়ায় এদেরকে পৃথক করা যায়। কিন্তু যদি মিশ্রণের উপাদানগুলোর স্ফুটনাঙ্কের পার্থক্য খুব কম হয় তখন সাধারণ পাতন প্রণালিতে এদের পৃথক করা যায় না। এক্ষেত্রে পাতন ফ্লাস্কের এবং শীতকের মধ্যে ‘অংশ কলাম’ ব্যবহার করে পাতন প্রক্রিয়ায় মিশ্রিত তরলের উপাদানগুলো পৃথক করা হয়। ‘অংশ কলাম’ ব্যবহার করে পাতন প্রক্রিয়ায় মিশ্রণের তরল উপাদানসমূহকে পৃথক করার প্রক্রিয়াকে আংশিক পাতন বলে।

বর্ণনা : একটি তরল মিশ্রণে তিনটি তরল A, B এবং C আছে। A এর স্ফুটনাঙ্ক 40° সে., B এর স্ফুটনাঙ্ক 70° সে. এবং C এর স্ফুটনাঙ্ক 128° সে.। সুতরাং এদের উদ্বায়িতার ক্রম হবে A > B> C। এই মিশ্রণকে পাতন ফ্লাস্কে নিয়ে তাতে একটি অংশ কলাম যুক্ত করে তাপ দিলে মিশ্রণটি ফুটতে থাকে এবং উৎপন্ন A, B এবং C এর বাষ্প অংশ কলামের ভিতর দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। বেশি উদ্বায়ী তরলের (A) বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় তা শীতক নলে প্রবেশ করে ঘনীভূত হয়ে তরলে পরিণত হয়ে গ্রাহক পাত্রে জমা হয় কিন্তু কম উদ্বায়ী B এবং C অংশ কলামের মধ্যেই তরলে পরিণত হয়ে আবার পাতন ফ্লাস্কে ফিরে আসে।

A তরলটির পাতন শেষ হলে ফ্লাস্কের তরলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং B এর বাষ্প শীতকে প্রবেশ করে শীতল হয়ে তরল আকারে গ্রাহক পাত্রে জমা হয়। এভাবে তরল মিশ্রণের উপাদান A, B এবং C মিশ্রণ থেকে পৃথক হয়ে যায়। পরবর্তীতে A, B এবং C তরলকে পুনরায় সাধারণ পাতন প্রক্রিয়ায় পাতন করে বিশুদ্ধ করা হয়।

বর্তমানে আংশিক পাতন প্রক্রিয়ায় পেট্রোলিয়াম বিশোধন, আলকাতরার অংশ পাতন, রেকটিফাইড স্পিরিট উৎপাদনসহ অসংখ্য পৃথকীকরণ করা হয় ।

বাষ্প পাতন (Steam distillation) :

মূলনীতি : যেসব কঠিন ও তরল জৈব যৌগ পানিতে অদ্রবণীয় এবং ফুটন্ত পানিতে বিয়োজিত হয় না তবে কিছু পরিমাণ হলেও বাষ্পায়িত হয়, তাদেরকে অনুদ্বায়ী ভেজাল হতে জলীয় বাষ্পের সাহায্যে পাতন করে পৃথক করার প্রক্রিয়াকে বাষ্প পাতন বা স্টিম পাতন বলে। বাষ্প পাতনের ক্ষেত্রে উদ্বায়ী জৈব পদার্থ তার স্বাভাবিক স্ফুটনাঙ্ক অপেক্ষা নিম্ন তাপমাত্রায় ফুটে বাষ্পায়িত হয় এবং এই বাষ্প প্রবহমান জলীয় বাষ্প কর্তৃক বাহিত হয়। এক্ষেত্রে জৈব যৌগের বাষ্পচাপ (Pi) ও জলীয় বাষ্পের চাপ (P2) এর সমষ্টি বায়ুচাপ (P) এর সমান হয়। অর্থাৎ P = P1 + P2

বর্ণনা : এই প্রণালিতে অবিশুদ্ধ উদ্বায়ী জৈব যৌগকে পাতন ফ্লাস্কে (F) নিয়ে তাতে জলীয় বাষ্প চালনা করা হয়। কোনো তরলের মধ্যে জলীয় বাষ্প চালনা করলে তা উত্তপ্ত হয় ও তার বাষ্পচাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। যখনই তরলটির বাষ্পচাপ ও আগত জলীয় বাষ্পের চাপের সমষ্টি বায়ুচাপের সমান হয় তখনই তরলটি ফুটতে আরম্ভ করে ও বাষ্পীভূত হয়ে জলীয় বাষ্পের সাথে শীতকের ভিতরে প্রবেশ করে। শীতকের ভিতর ঠাণ্ডা পানির শৈত্যে জলীয় বাষ্প ও তরলের বাষ্প ঘনীভূত হয়ে গ্রাহক পাত্রে তরলাকারে জমা হয়।

একটি টিনের পাত্রে (B) পানি ফুটিয়ে জলীয় বাষ্প উৎপাদন করা হয় ও পাতন ফ্লাস্কটি চিত্রানুযায়ী কাত করে তার মধ্যে জলীয় বাষ্প চালনা করা হয় যাতে তরলটি লাফ দিয়ে নির্গম নল পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। টিনের পাত্র (B) এবং পাতন ফ্লাস্কে (F) এমনভাবে তাপ প্রদান করা হয় যাতে পাতন ফ্লাস্কে প্রবিষ্ট ও তা থেকে নির্গত বাষ্পের পরিমাণ প্রায় সমান থাকে। গ্রাহক পাত্রে সঞ্চিত জৈব তরলের সাথে পানি মিশ্রিত থাকে। জৈব তরলটি পানির সাথে মিশ্রণীয় নয় বলে সহজেই পৃথকীকরণ ফানেলের সাহায্যে পানি হতে তরলকে পৃথক করে নেওয়া যায় ।

প্রয়োগ : বিভিন্ন শিল্পকারখানায় এ পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে-

(i) সুগন্ধি ফুল হতে ফুলের নির্যাস।

(ii) ইউকেলিপটাস পাতা হতে ইউকেলিপটাস তৈল নিষ্কাশন।

(iii) নাইট্রোবেনজিনকে বিজারণ করে প্রাপ্ত অ্যানিলিনের বিশোধন করা হয় ।

ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation)

পদার্থসমূহ সাধারণত তিনটি অবস্থায় থাকতে পারে। যেমন— কঠিন পদার্থকে তাপ প্রয়োগ করলে প্রথমে তরলে এবং পরে আরও বেশি তাপ প্রয়োগ করলে বাষ্পে পরিণত হয়। আবার গ্যাসীয় পদার্থকে ঠাণ্ডা করলে প্রথমে তরলে পরিণত হয় এবং তরলকে আরও বেশি ঠাণ্ডা করলে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়।

 

মূলনীতি : যে প্রক্রিয়ায় কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রয়োগে সরাসরি বাষ্পে পরিণত করে সেই বাষ্পকে শীতল করলে আবার তরল অবস্থা প্রাপ্ত না হয়ে সরাসরি কঠিন অবস্থায় ফিরে আসে তাকে ঊর্ধ্বপাতন বলে । কক্ষ তাপমাত্রায় যেসব কঠিন পদার্থের বাষ্পচাপ (P,) বায়ুচাপ (P) অপেক্ষা বেশি অর্থাৎ P> P কেবল সেসব পদার্থই ঊর্ধ্বপাতিত হয়ে থাকে । প্রকৃতিতে এ ধরনের পদার্থের সংখ্যা খুবই সীমিত ।

ঊর্ধ্বপাতনধর্মী যেকোনো পদার্থকে সহজেই অনুদ্বায়ী কঠিন পদার্থের মিশ্রণ হতে ঊর্ধ্বপাতিত করে পৃথক করা যায়। প্রথমে মিশ্রণকে একটি চীনামাটির বেসিনে নিয়ে একটি ফানেলকে বেসিনের উপর উপুড় করে বসিয়ে দিয়ে ফানেলের নলটি তুলা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ফানেলের গায়ে ভিজা ন্যাকড়া বা ভিজা ফিল্টার কাগজ জড়িয়ে বেসিনটিকে উত্তপ্ত করলে উদ্বায়ী পদার্থটি ঊর্ধ্বপাতিত হয়ে ফানেলের গায়ে জমা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বেনজয়িক এসিডকে (গলনাঙ্ক 121° সে.) ধীরে ধীরে তাপ প্রয়োগ করলে এটি 100° সে. তাপমাত্রায় ঊর্ধ্বপাতিত হয়। অবিশুদ্ধ বেনজয়িক এসিডকে এভাবে বিশোধন করা হয়। কর্পূর, ন্যাপথালিন, নিশাদল, আয়োডিন ইত্যাদি তাপে ঊর্ধ্বপাতিত হয় ।

আবার, যেসব কঠিন জৈব যৌগকে স্বাভাবিক বায়ুচাপে উত্তপ্ত করলে আংশিক বিয়োজিত হয় তাদেরকে নিম্নচাপে ঊর্ধ্বপাতিত করে বিশোধন করা হয়। এক্ষেত্রে একটি সরু পার্শ্বনলযুক্ত মোটা কাচনলের তলদেশে অবিশুদ্ধ জৈব যৌগটি নেওয়া হয়। কাচনলের মুখে ছিপির সাহায্যে একটি শীতক যুক্ত করা হয়। কাচনলের পার্শ্বনলকে রবার টিউবের সাহায্যে পাম্পের সাথে যুক্ত করে নলের ভিতরের বায়ুচাপ কমানো হয়। শীতকে পানির প্রবাহ অব্যাহত রেখে মোটা কাচনলে তাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে ঊর্ধ্বপাতনযোগ্য জৈব যৌগ ঊর্ধ্বপাতিত হয়ে শীতকের গায়ে জমা হয় ।

দ্রাবক নিষ্কাশন (Solvent Extraction)

জৈব যৌগসমূহ পানি অপেক্ষা জৈব দ্রাবক যেমন— ইথার, অ্যালকোহল, ক্লোরোফরম ইত্যাদিতে অধিক দ্রবণীয়। দ্রাবক নিষ্কাশন পদ্ধতিতে কঠিন এবং তরল উভয় প্রকার যৌগই বিশুদ্ধ করা যায়। কোনো জৈব যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হলে তাকে নির্দিষ্ট কোনো জৈব দ্রাবক দ্বারা বিশুদ্ধ আকারে পৃথক করা যায় তবে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈব দ্রাবকটি পানিতে অমিশ্রণীয় হতে হবে।

“কোনো জৈব যৌগকে জলীয় দ্রবণ বা অন্য কোনো জৈব দ্রাবকের দ্রবণ হতে উপযুক্ত দ্রাবক যোগে পৃথক করার পদ্ধতিকে দ্রাবক নিষ্কাশন বলে।”

দ্রাবক নিষ্কাশন দুভাবে হতে পারে। যথা— (ক) জলীয় দ্রবণ হতে নিষ্কাশন এবং (খ) কঠিন পদার্থ হতে নিষ্কাশন ।

জলীয় দ্রবণ হতে নিষ্কাশন :

যখন কোনো জৈব যৌগ জলীয় দ্রবণে দ্রবীভূত থাকে তখন সেই জৈব যৌগকে জলীয় দ্রবণ হতে নিম্নোক্ত কয়েকটি ধাপে পুনরুদ্ধার করা হয়।

(১) জলীয় দ্রবণকে পানিতে অমিশ্রণীয় জৈব দ্রাবক দ্বারা উত্তমরূপে ঝাঁকানো হয় । ফলে জৈব যৌগ জৈব দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় ।

(২) দ্রাবক স্তরকে পৃথকীকরণ ফানেলের সাহায্যে পৃথক করা হয় ।

(৩) দ্রাবককে পাতন করে জৈব যৌগ এবং দ্রাবক বিশুদ্ধরূপে পৃথক করা হয় ।

বর্ণনা : জলীয় দ্রবণকে একটি পৃথকীকরণ ফানেলে (Separating funnel) নেওয়া হয়। দ্রবণে অল্প পরিমাণে জৈব দ্রাবক, যেমন- ইথার বা ক্লোরোফরম যোগ করা হয়। পানিতে জৈব দ্রাবক অমিশ্রণীয় হওয়ায় পানি ( এবং দ্রাবক আলাদা আলাদা স্তর গঠন করে। পৃথকীকরণ ফানেলের মুখ কর্ক দিয়ে বন্ধ করার পর ফানেলকে দুহাতে ধরে উত্তমরূপে ঝাঁকিয়ে স্ট্যান্ডের সাহায্যে স্থিরভাবে ফানেলকে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

জৈব যৌগ জৈব দ্রাবকে পানি অপেক্ষা অধিক পরিমাণে দ্রবণীয় হওয়ায় তা জলীয় দ্রবণ হতে জৈব দ্রাবকে দ্রবীভূত অবস্থায় চলে আসে। এখন পৃথকীকরণ ফানেলের নিচের স্তরকে স্টপ কর্ক খুলে অন্য পাত্রে পৃথক করা হয়। দ্রাবক স্তরকে পরবর্তীতে পাতন প্রক্রিয়ায় জৈব যৌগ এবং দ্রাবক উভয়কেই বিশুদ্ধ অবস্থায় পৃথক করা হয় ।

কঠিন পদার্থ হতে নিষ্কাশন : স-লেট নিষ্কাশন :

এই নিষ্কাশন পদ্ধতিতে কোনো কঠিন জৈব যৌগের বিশোধন করা হয়। এমন একটি সুবিধাজনক জৈব দ্রাবক নির্বাচন করা হয় যাতে জৈব যৌগ দ্রবীভূত হয় অথচ ভেজাল উপাদানসমূহ দ্রাবকে অদ্রবণীয় হয়। প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন— গাছের বাকল, পাতা, কাণ্ড, শুকনা ফল ইত্যাদি হতে এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ নিষ্কাশন করা হয়। এজন্য বিশেষ নিষ্কাশন যন্ত্র সক্সলেট এক্সট্রাকটর ( Soxhlet Extractor) ব্যবহার করা হয়।

এতে একটি গ্লাস সিলিন্ডার (C) এবং এর এক পার্শ্বে পার্শ্বটিউব (T) এবং অন্য পার্শ্বে সাইফন (S) যুক্ত আছে। সিলিন্ডারটির উপরে একটি লিবিগ শীতক কর্কের মাধ্যমে এবং নিচের অংশে একটি পাতন ফ্লাস্ক যুক্ত থাকে। যে প্রাকৃতিক উৎস হতে জৈব যৌগ নিষ্কাশন করা হবে তাকে (গাছের পাতা, কাণ্ড, বাকল ইত্যাদি) ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এই গুঁড়ো বস্তু একটি পুরু ফিল্টার পেপার মুড়িয়ে (চিত্রানুযায়ী) সিলিন্ডারের মাঝখানে ভালোভাবে বসানো হয়।

পাতন ফ্লাস্কে সুবিধাজনক দ্রাবক নিয়ে পাত্রটিকে পানিগাহে বা বালিখোলায় বসিয়ে উত্তপ্ত করা হয়। দ্রাবক উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে পরিণত হতে থাকে এবং সেই বাষ্প পার্শ্বনল (T) বেয়ে শীতকে পৌঁছায়। শীতকে বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তরলে পরিণত হয়। এ তরল ফোঁটায় ফোঁটায় ফিল্টার পেপার মোড়ানো টোপরের উপর পড়ে। দ্রাবকে জৈব যৌগ দ্রবীভূত হয়ে দ্রাবকসহ সাইফনের সাহায্যে পুনরায় পাতন ফ্লাস্কে ফিরে আসে। এভাবে অবিরাম প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। সবশেষে পাতন ফ্লাস্ক হতে জৈব যৌগের দ্রবণকে আংশিক পাতন করে জৈব যৌগকে বিশুদ্ধ অবস্থায় পৃথক করা হয়।

সক্সালেট নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় গাছের পাতা বা বাকল থেকে অ্যালক্যালয়েড জাতীয় জৈব যৌগ, বীজ থেকে তৈল ফুল থেকে সুগন্ধি জাতীয় পদার্থ নিষ্কাশন করা হয়।

 

 

 

আরও পড়ুন…

 

 

Exit mobile version