পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “পদার্থের অবস্থা” ইউনিট ৪ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা
পদার্থের অবস্থা (States of Matter) :
যার ভর আছে, স্থান দখল করে, স্থিতিশীল ও গতিশীল অবস্থার পরিবর্তনে বাধা সৃষ্টি করে তাকে পদার্থ বলা হয়। সাধারণভাবে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য অবস্থার উপর ভিত্তি করে পদার্থকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কঠিন অবস্থা, তরল অবস্থা ও গ্যাসীয় অবস্থা ।
কঠিন অবস্থা (Solid state) :
পদার্থের এ অবস্থায় নির্দিষ্ট ভরের পদার্থের নির্দিষ্ট আকৃতির, নির্দিষ্ট আয়তন ও আকৃতি থাকে। এ অবস্থায় পদার্থের নির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক গঠন বিন্যাসে থাকে। এ অবস্থায় উপাদান কণাগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল খুবই প্রবল থাকে এবং উপাদান কণার গতিশক্তি খুবই নগণ্য। গতিশক্তি কম হওয়ায় সুনির্দিষ্ট নিয়মে সজ্জিত থাকে। এ কারণে নির্দিষ্ট আকৃতির ও উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট হয়। এ অবস্থায় পদার্থের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ শক্তি গতিশক্তির তুলনায় অনেক বেশি থাকে।
তরল অবস্থা (Liquid state ) :
এ অবস্থায় পদার্থের ভর ও আয়তন নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু আকার নির্দিষ্ট থাকে না। তরল পদার্থকে যে পাত্রে রাখা হয় ভরও আয়তনের কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে সে পাত্রের আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় অণুগুলোর মধ্যকার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল কঠিন অবস্থার তুলনায় কম বলে অণুগুলো দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে না। অণুগুলোর গতিশক্তি কঠিন অবস্থার তুলনায় যথেষ্ট বেশি বলে অতি সহজে চলাচল করতে পারে। এ কারণে তরল অবস্থায় পদার্থের প্রবাহ গুণ থাকে এবং আকৃতি সহজে পরিবর্তনশীল হয়। এ অবস্থায় পদার্থের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল ও গতিশক্তি প্রায় সমান হয়।
গ্যাসীয় অবস্থা (Gasious state) :
এ অবস্থায় পদার্থ ওর ভর নির্দিষ্ট রাখে কিন্তু কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট আকার বা আকৃতি বজায় রাখতে পারে না। এ অবস্থায় যতো কম পরিমাণের পদার্থ হোক না কেন তা পাত্রকে পূর্ণ করে অবস্থান করবে। এর মূল কারণ এ অবস্থায় উপাদান অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল কার্যকর হয় না বললেই চলে। অণুগুলোর গতিশক্তিও অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায় এবং বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীন স্বত্ত্বায় এদিক ওদিক চলাচল করতে থাকে। গ্যাসীয় অবস্থায় একদিকে ঘনত্ব যেমন মারাত্মকভাবে কমে যায় অন্যদিকে সংকোচনশীলতা মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায়। এ জন্য আকার ও আয়তন স্থির থাকে না। এ অবস্থায় উপাদান কণাগুলোর গতিশক্তি আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের তুলনায় অনেক বেশি হয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদার্থের গ্যাসীয় অবস্থাকে বাষ্প বলা হয়। এটি মোটেই ঠিক নয়। বাষ্প হলো সন্ধি তাপমাত্রার নিচে পদার্থের গ্যাসীয় অবস্থা মাত্র। এ অবস্থায় শুধুমাত্র চাপ প্রয়োগে সংকুচিত করে গ্যাসকে পরিবর্তিত করে তরল অবস্থায় রূপান্তরিত করা যায়।
মনে রাখবেন : পদার্থের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল গতিশক্তির তুলনায় বেশি হলে কঠিন অবস্থা, আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল এবং গতিশক্তি সমান হলে তখন তরল অবস্থা। আর যদি উপাদান কণার গতিশক্তি, আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের তুলনায় অনেক বেশি হয় তবে পদার্থ গ্যাসীয় অবস্থায় অবস্থান করবে।
উল্লিখিত তিনটি অবস্থা ছাড়াও পদার্থের আরো দুটি অবস্থা দেখা যায়। একটি তরল স্ফটিক অবস্থা এবং অপরটি প্লাজমা অবস্থা ।
তরল স্ফটিক অবস্থা (Liquid crystal state) :
বেশ কিছু দানাদার কঠিন পদার্থ আছে যাদেরকে তাপ প্রয়োগের ফলে সরাসরি স্বচ্ছ তরলে পরিণত না হয়ে কঠিন ও তরলের মাঝামাঝি একটি অস্বচ্ছ অবস্থার সৃষ্টি করে অবস্থান করে। পদার্থের এ অবস্থা হলো তরল স্ফটিক । পদার্থের তরল স্ফটিক অবস্থা দুটি তাপমাত্রার ব্যবধানে অবস্থান করে— গলন তাপমাত্রা ও স্বচ্ছকরণ তাপমাত্রা ।
কঠিন স্ফটিক = তাপমাত্রা/গলন – তরল স্ফটিক (অস্বচ্ছ) = তাপমাত্রা/স্বচ্ছকরণ → স্বচ্ছ তরল
তরল স্ফটিক অবস্থায় পদার্থের মধ্যে কঠিন অবস্থার ধর্ম ও তরল অবস্থার ধর্ম বর্তমান থাকে। কঠিন অবস্থার ধর্ম যেমন- সুনির্দিষ্ট বিন্যাস, দৃঢ়তা, সান্দ্রতা ও আলোক ধর্ম বর্তমান। আবার তরল অবস্থার ধর্ম যেমন— প্রবাহ ধর্ম, পৃষ্ঠতলটান বর্তমান কিন্তু নির্দিষ্ট আকার থাকে না। আধুনিক বিজ্ঞানের চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার যথেষ্ট। ইলেকট্রোনিক্স শিল্পেও এর ব্যবহার কম নয়। ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, কম্পিউটারের মনিটর, টিভির স্ক্রিন, ডিসপ্লেসাইন, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে এর ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
প্লাজমা অবস্থা (Plasma state) :
এ অবস্থায় পদার্থ তার সর্বোচ্চ গতিশক্তি প্রান্ত হয়। পদার্থ তার উপাদান কণায় বিয়োজিত হয়ে প্রতিটি কণা আধানযুক্ত হয় এবং প্রচণ্ড গতিশক্তির কারণে ছুটাছুটি করতে থাকে কিন্তু বিপরীত আধানের মধ্যে কোনরূপ আকর্ষণ বল অনুভূত হয় না। সাধারণত 10-107 K তাপমাত্রায় বেশ কিছু পদার্থকে প্লাজমা অবস্থায় অবস্থান করতে দেখা যায়। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র মণ্ডলের মধ্যে পদার্থ প্লাজমা অবস্থায় অবস্থান করে । পারমানবিক চুল্লীর মধ্যে যখন নিউক্লিয়ার ফিউশান ঘটানো হয় তখন পদার্থকে প্লাজমা অবস্থায় পরিবর্তন করে নেয়া হয় ।
গ্যাসের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Gas) :
কক্ষ তাপমাত্রায় যে সব উপাদান বায়বীয় অবস্থায় থাকে তাকে গ্যাস বলা হয়। যেমন— O2, N2, H2, CO2, He এ সকলেই গ্যাসীয় পদার্থ। গ্যাসীয় পদার্থগুলো বেশিকিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। যেমন—
১। আকার ও আয়তন : গ্যাসীয় পদার্থের কোনো নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন নেই। সাধারণত যে পাত্রে গ্যাসকে রাখা হয় সে পাত্রের আয়তনই গ্যাসের আয়তন বলে ধরা হয়।
২। সম্প্রসারণশীলতা : গ্যাসের সম্প্রসারণ ক্ষমতা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। যে পাত্রে গ্যাস রাখা হয় খুব দ্রুত ঐ পাত্রের সমস্ত জায়গায় গ্যাস বিস্তৃত হয়ে পড়ে।
৩। ব্যাপন : গ্যাসের ব্যাপনের ক্ষমতা খুব বেশি। দুই বা ততোধিক গ্যাস পরস্পরের মধ্যে দ্রুত গতিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করে থাকে। গ্যাস অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক শূন্য স্থান থাকে বলে এটি সম্ভব হয়।
৪। আন্তঃকণা আকর্ষণ বল : গ্যাস অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল খুবই নগণ্য। এ বলের মান ততই কম যে সাধারণভাবে একে শূন্য বলে ধরে নেয়া হয় ।
৫। ঘনত্ব : কক্ষতাপমাত্রায় গ্যাসের ঘনত্ব খুবই কম। উপাদানের একক আয়তনের ভরকে উপাদানের ঘনত্ব বলা হয়। গ্যাসীয় অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক দূরত্ব অধিক হওয়ায় একক আয়তনে গ্যাস অণুর সংখ্যা কম হয়। এ কারণে একক আয়তনের ভর তথা ঘনত্ব কম হয় ।
৬। গ্যাসের চাপ : যে পাত্রে গ্যাস রাখা থাকে ঐ গাত্রের দেয়ালের উপর গ্যাস চাপ প্রয়োগ করে। গ্যাস অণুগুলো গতিশীল থাকায় পাত্রের দেয়ালে চাপ বা বল প্রয়োগ করে। গ্যাস অণুগুলো কর্তৃক আরোপিত এ চাপ পাত্রের উপরে, নিচে, পার্শ্বে সব জায়গায় সমান থাকে। প্রকৃত পক্ষে স্থির তাপমাত্রায় একক ক্ষেত্রফলের উপর পাত্রের দেয়ালে গ্যাস যে বল প্রয়োগ করে তাকে গ্যাসের চাপ বলা হয়।
৭। অণুর গতি : গ্যাস অণুগুলোর গতিশক্তি যথেষ্টভাবে অধিক এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত কারণে অণুগুলোর গতিশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। গ্যাস অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল খুবই কম হওয়ায় অণুগুলো স্বাধীন এবং বিক্ষিপ্তভাবে গতিশীল থাকে ।
৮। সমসত্ত্ব মিশ্রণ : ভিন্ন ভিন্ন গ্যাস অণুগুলো যে কোনো অণুপাতে মিশ্রিত হয়ে সমসত্ত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন করে। গ্যাসের অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক শূন্যস্থান থাকে। ভিন্ন ভিন্ন গ্যাসঅণুগুলোকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনলে যদি বিক্রিয়া না করে তবে অণুগুলোর গতিশক্তির কারণে একটি গ্যাসের অণুগুলোর শূন্য স্থানের মধ্যে অপর গ্যাসের অণুগুলো স্থান করে নেয়। এর ফলে গ্যাসীয় অবস্থায় পদার্থ সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করে ।
৯। অবস্থার পরিবর্তন : নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চ চাপে একে তরলে পরিণত করা সম্ভব হয়। ১০। তাপমাত্রা : তাপমাত্রা বাড়লে গ্যাসের অণুগুলোর শক্তি বেড়ে যায়। এ শক্তির বৃদ্ধি ফলে অণুগুলো কম্পনজনিত শক্তি, ঘূর্ণনজনিত শক্তি, বিচ্ছিন্নভাবে চলাচলের গতিশক্তি সবই বেড়ে যায়।
গ্যাসের আয়তন (Volume of Gas) :
গ্যাস অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল খুবই নগণ্য হওয়ায় যে পাত্রে গ্যাসকে রাখা হয় সে পাত্রকে গ্যাস পূর্ণ করে রাখে। যে পাত্রে গ্যাস রাখা হয় গ্যাস অণুগুলো কর্তৃক দখলকৃত আয়তনকে ঐ গ্যাসের আয়তন বলা হয়। প্রকৃত পক্ষে গ্যাস রক্ষিত পাতের আয়তনকে গ্যাসের আয়তন হিসেবে গণ্য করা হয় ।
গ্যাসের আয়তনকে SI এককে ঘনমিটার (Cubic metre) বা m এ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ঘন ডেসিমিটার (Cubic decimetre) বা dm3 এবং ঘন সেন্টিমিটার (Cubic Centimetre) বা cm এ প্রকাশ করা হয় । 1m’ = 1000 L = 103 dm3 = 10′ cm3
গ্যাসের চাপ (Pressure of Gas) :
গ্যাস অণুগুলো মুক্তভাবে পাত্রের মধ্যে ছোটাছুটি করে। গ্যাস অণুগুলো কর্তৃক পাত্রের দেয়ালের প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর আরোপিত বলকে গ্যাসের চাপ বলা হয় ।
পদার্থের অবস্থা ঃ
পদার্থ : মৌলিক ধারণা :
আরও পড়ুন…