কৌটাজাতকরণ (মাছ ও মাংস কৌটাজাতকরণ)

কৌটাজাতকরণ (মাছ ও মাংস কৌটাজাতকরণ) আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “কর্মমুখী রসায়ন” ইউনিট ৭ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

কৌটাজাতকরণ (মাছ ও মাংস কৌটাজাতকরণ)

মাছ কৌটাজাতকরণ (Canning of Fish)

মাছ অত্যন্ত উচ্চমান সম্পন্ন প্রোটিন, চর্বি ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ খাবার। সারা পৃথিবীতে মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। আমাদের দেশে এ চাহিদা ব্যাপক। মাছ ভাতে বাঙালি ও প্রবাদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত। এদেশের নদীনালা, খালবিল, হাওর বাঁওড়, সমুদ্রে প্রচুর মৎস্য সম্পদ রয়েছে। এর সঠিক সংরক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে ও মূল্যবান জাতীয় সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারি।

পুষ্টিমানের দিক থেকে মাছের মধ্যে সাধারণ নিচের উপাদান বর্তমান থাকে ।

মাছের প্রোটিন খুবই উচ্চমান সম্পন্ন ও সহজে হজমযোগ্য মাছের চর্বিতে থাকে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড যা খুব সহজেই সব বয়সের মানুষ হজম করতে পারে। মাছের এ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড জারণ ক্রিয়ার প্রতি খুবই সংবেদনশীল। তাই মাছে পচনশীল খাদ্যদ্রব্য। মাছের এ চর্বিই কিন্তু ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘ডি’ এর উত্তম উৎস।

কৌটাজাতকরণ পদ্ধতি : মাছ কৌটাজাতকরণের ক্ষেত্রে মিটাপানির ছোট মাছ অপেক্ষা বড় আকারের মাছ এবং সামুদ্রিক মাছ হলে অপেক্ষাকৃত ভালো হয়। মাছকে সঠিকভাবে কৌটাজাত করলে দুই তিন বছর পর্যন্ত একে সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত তাজা বা এক দুই ঘণ্টা পূর্বে মৃত মাছকে নিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধুয়ে মাছের আঁশ থাকলে তা অপসারণ করা হয়।

পেট কেটে পেটের ময়লা ও ফুলকা ফেলে দেওয়া হয়। মাছের মাথা কেটে পৃথক করে নেওয়া হয়। মাছের মাথা সংরক্ষণ করা যায় না। মাছ কেটে টুকরা করে পরিমাণমতো আকারে পরিণত করা হয়। লেজের কিছু অংশকেও অপসারণ করা হয। বিশুদ্ধ পানি দ্বারা পুনরায় ধুয়ে কিছুক্ষণের জন্য চালুনি বা তারজালির উপর রাখা হয়। পানি অপসারিত হয়। নরম শুকনো কাপড়ের মধ্যে রেখে সামান্য চাপ প্রয়োগ করে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া হয়।

মাছের টুকরাগুলোকে ৭–৮% খাদ্য লবণের দ্রবণের মধ্যে প্রায় ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। দ্রবণ থেকে তুলে এনে কিছু সময়ের জন্য চালুনিতে রাখা হয়। অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়। প্রস্তুতকৃত পরিষ্কার কৌটার মধ্যে মাছকে ভর্তি করা হয় এবং এর মাঝে মাঝে ২% খাদ্য লবণ ও ২% চিনির দ্রবণ যোগ করা হয় ।

এভাবে কৌটার মধ্যে মাছকে রেখে উপরিভাগে পুনরায় ২% খাদ্য লবণ ও ২% চিনি দ্রবণ যোগ করা হয়। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে যে কৌটার উপরের দিকে সামান্য জায়গা যেন খালি থাকে । কৌটাকে ফুটন্ত পানিতে ২/৩ অংশ ডুবিয়ে অথবা বাষ্পের সাহায্যে তাপ প্রয়োগ করে কৌটার সব বায়ু অপসারণ করে দেয়া হয়। এ কাজের জন্য ৮–১০ মিনিট সময়ই যথেষ্ট এ প্রক্রিয়াকে একজসটিং বলে।

একজসটিং এর পরপরই ঢাকনা দিয়ে কৌটার মুখ সম্পূর্ণভাবে বায়ুরোধী করে সিল করা হয়। সিল করা কৌটাপকে প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে ১১০-১১৫°C তাপমাত্রায় স্টেরিলাইজেশন করা হয়। কৌটাকে ঠাণ্ডা করে লেবেল লাগিয়ে শুষ্ক জায়গায় নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। পরে সুবিধামতো বাজারজাত করা হয় ।

 

খাদ্য লবণ দ্বারা মাছ কৌটাজাতকরণ :

মাছ খাদ্য লবণ দ্বারা সংরক্ষণের বহুল প্রচলিত পদ্ধতি কিউরিং। খাদ্যদ্রব্যকে খাবার লবণ বা এর নির্দিষ্ট ঘনমাত্রার দ্রবণ দ্বারা সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়াকে কিউরিং বলে। ফ্রিজ আবিষ্কারের পূর্বে এ পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয় ছিল। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এ ইলিশ মাছের উপর থেকে আঁশ অপসারণ করে, পেট কেটে ভিতরের সব অপ্রয়োজনীয় উপাদানকে অপসারণ করে নেওয়া হয়। কানশিরা ও ফুলকাকে অপসারণ করে মাছের গায়ের উপর এক ইঞ্চি অন্তর অন্তর ছুড়ি বা বটি দিয়ে বেশ পুরু করে কাটা হয় ।

বিশুদ্ধ পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে মাছকে চালুনি বা তারজালির উপর রাখা হয়। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে পানি ঝরে যায়। অতিরিক্ত পানি অপসারণের জন্য নরম, পাতলা, শুকনো কাপড়ের উপর রেখে আরেকটি কাপড় দ্বারা ঢেকে ধীরে ধীরে চাপ দেওয়া হয়। ফলে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে আসে। ফালি করা মাছকে ৭–৮% NaCl দ্রবণের মধ্যে প্রায় ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। দ্রবণ থেকে মাছকে তুলে পুনরায় চালুনি বা তারজালির উপর ১০-১৫ মিনিট রাখা হয়। ফলে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায় ।

প্রতি চার কেজি প্রক্রিয়াজাতকরণ মাছের জন্য এক কেজি পরিমাণ লবণকে ব্যবহার করা হয়। যে পাত্রে মাছকে সংরক্ষণ করতে হবে ঐ পাত্রের মধ্যে পরিমিত পরিমাপণ খাদ্য লবণকে ছড়িয়ে দিয়ে মাছকে পরপর করে সাজানো হয়। প্রতিটি সারির উপর নতুন করে খাবার লবণকে ভালোমতো ছড়িয়ে দিতে হয়। পাত্রের উপর কিছু অংশ খালি রেখে পাত্রকে ঢাকনা দ্বারা ঢেকে রাখা হয়।

কয়েকদিন পর পর ঢাকনা খুলে সংরক্ষিত মাছ ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা যায়। এ প্রক্রিয়ায় একইভাবে মাছকে সম্পূর্ণ টুকরা টুকরা করেও সংরক্ষণ করা যায়। দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে লবণের দ্রবণে সামান্য ল্যাকটিক এসিড ব্যবহার করা হয়। ল্যাকটিস এসিড অণুজীবগুলোকে বংশবিস্তার করতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে সংরক্ষিত খাদ্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে ।

মাংস কৌটাজাতকরণ (Canning of Meat) :

মাংস বলতে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতির মাংসকে বোঝানো হয়। যা উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি খাবার। সঠিক নিয়মে কৌটাজাত করলে ২–৩ বছর পর্যন্ত এটাকে সংরক্ষণ করা সম্ভব। বর্ণিত পশুর মাংসের মধ্যে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো পাওয়া যায় :

সাধারণত সুস্থ, সবল এবং সচল কোনো পশুর মাংসের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো অণুজীব (micro organism) থাকে না। মাংস প্রোসেস করার সময় ছুরি, দা, পশুর লোম, রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, ধূলিবালি, দূষিত পানি প্রভৃতি মাংসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মাংসের সাধারণ গুণাবলি বিনষ্ট করে দেয় এবং অনেক সময় পচন ধরে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। মাংসের গুণগত মান বজায় রেখে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করাই সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য।

পদ্ধতি : সুস্থ, সবল এবং মাঝারি বয়সের পশুকে জবাই করে চামড়া পৃথক করা হয় এবং মাংসকে সাইজমতো টুকরা করা হয়। মাংস কাটার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই টুকরাগুলো থেঁতলিয়ে না যায়। হাড়, কলিজা, ফুসফুস, মস্তক, চর্বি এবং অন্যান্য বস্তুগুলোকে আলাদা করে শুধু মাংসের টুকরাগুলোকে নির্বাচন করতে হয়। টুকরাকৃত মাংসকে পরিষ্কার নলকূপের পানি দ্বারা অথবা দূষিত নয় এমন পানি ব্যবহার করে ধুয়ে নেওয়া হয়। স্টিলের নেটে বা বাঁশের তৈরি পরিষ্কার ডালির উপর রেখে অতিরিক্ত পানি অপসারিত করা হয়। অতঃপর পরিষ্কার এবং নরম শুকনা কাপড় ব্যবহার করে চাপ দিলে অবশিষ্ট পানি বের হয়ে যাবে।

এবার যে কৌটার মধ্যে মাংস সংরক্ষণ করা হবে তাকে আগেই পরিষ্কার করে নিয়ে রাখা হয় এবং এতে 2% লবণের দ্রবণ এবং 2% চিনির দ্রবণ দ্বারা ধৌত করে টুকরা করা মাংস দ্বারা ভর্তি করা হয়। কৌটার উপরের দিকে 1–2 ইঞ্চি স্থান ফাঁকা রাখা হয়। এরপর কৌটার মধ্যে 2% লবণের দ্রবণ এবং 2% চিনির দ্রবণ ঢেলে দিয়ে মাংসের টুকরাগুলোকে দ্রবণের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এবার মাংস ভর্তি কৌটা বা ক্যানটিকে পানিপূর্ণ অপর একটি পাত্রের মধ্যে স্থাপন করা হয় যাতে ক্যান বা কৌটার দুই-তৃতীয়াংশ পানির মধ্যে থাকে ।

তাপ প্রয়োগে কৌটার ভিতরের বায়ু বের করে দেওয়া হয়। বায়ুরোধী করার পর সিল করা কৌটা বা ক্যানকে 120°C তাপমাত্রায় প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ তাপ প্রয়োগ করে স্টেরিলাইজেশন করা হয়। ঠাণ্ডা করে ক্যানের বা কৌটার গায়ে লেবেল লাগিয়ে উৎপাদনের তারিখ এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লিখে শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা স্থানে সংরক্ষণ করা হয়।

মাছ-মাংস সংরক্ষণে ভিনেগার :

মাছ-মাংস একটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য কিন্তু এটি নির্দিষ্ট সময় পর অতি সহজেই অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। শুধু অণুজীব কেন বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলেও মাছ-মাংস নষ্ট হয়ে যায়। যেমন— মাছ-মাংসে উপস্থিত তেল ও চর্বির জারণ ক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলো নষ্ট হয়ে টক স্বাদ ও দুর্গন্ধযুক্ত হয় । মাছ-মাংসকে ভিনেগারের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করলে এগুলো অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয় না এবং এর পুষ্টি মানেরও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। ভিনেগারের সাহায্যে মাছ-মাংসকে দীর্ঘ সময় মানসম্মত রেখে সংরক্ষণ করা যায়।

এর ফলে মাছ-মাংসের সঠিক বর্ণও অপরিবর্তিত থাকে। মাছ-মাংস কৌটাজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রিজারভেটিভস্ হিসেবে ভিনেগারের ব্যবহার অপরিসীম। ভিনেগারের সাহায্যে মাছ-মাংস সংরক্ষণের ফলে সারা বছর একে ব্যবহার উপযোগী রেখে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যায়। উৎপাদন মৌসুমে মাছকে সংরক্ষণ করে সারা বছরব্যাপী দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এমনকি এক দেশ হতে অন্য দেশে একে সরবরাহ করা যায়। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সহজে বহনযোগ্য ও ব্যবহার উপযোগী হয় । এটি বিক্রেতার জন্যও খাদ্যদ্রব্যের ক্রেতার কাছে উপস্থাপনের সুন্দর ব্যবস্থা। উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা ইচ্ছামতো আকর্ষণীয় প্যাকেজিং এর মাধ্যমে সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্য বাজারে সরবরাহ করতে পারে।

 

Leave a Comment