আইসোটোপ ও মৌলের তেজস্ক্রিয়তা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “পারমাণবিক গঠ” ইউনিট ১ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
আইসোটোপ ও মৌলের তেজস্ক্রিয়তা
আইসোটোপ :
1912 সালে সর্বপ্রথম তেজষ্ক্রিয় পদার্থে আইসোটোপ থাকার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। 1916 সালে জে.জে. থমসন ( J. J. Thomson) নিয়নের একটি নমুনায় 22 amu ভরের অতি সামান্য পরিমাণে এবং 20 amu ভরের অধিকাংশ নিয়ন অণু শনাক্ত করেন। তিনি সর্বপ্রথম ধারণা করেন, নিয়ন নমুনায় 22 amu (atomic mass unit) ভরের কোনো নতুন মৌল থাকতে পারে।
“যেসব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা একই কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন তাদেরকে পরস্পরের আইসোটোপ বলে।”
যেহেতু আইসোটোপগুলোর প্রোটন সংখ্যা বা পারমাণবিক সংখ্যা একই তাই এরা একই মৌলের পরমাণু। নিম্নে উদাহরণ দেওয়া হলো—
আইসোটোপসমূহের (গ্রিক শব্দ iso = একই, top = স্থান) প্রোটন সংখ্যা একই হওয়ায় পর্যায় সারণিতে এদের স্থান একই জায়গায় নির্ধারিত।
আইসোবারসমূহের প্রোটন সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় পর্যায় সারণিতে এদের অবস্থানও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। এদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মও ভিন্ন ভিন্ন ।
আইসোটোন :
প্রকৃতিতে এমন কতিপয় পরমাণু রয়েছে যাদের নিউট্রন সংখ্যা সমান কিন্তু প্রোটন সংখ্যা এবং ভর সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন, এসব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোন বলে। আইসোটোনসমূহের প্রোটন সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় এরা ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর হয়ে থাকে। 14 14 পর্যায় সারণিতে এদের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। এদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন- C ও N
তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity):
1896 খ্রিস্টাব্দে হেনরি বেকোরেল (H. Becquerel) লক্ষ্য করেন ইউরেনিয়ামের স্থান থেকে সারাক্ষণ এক ধরনের অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ ঘটে। এ রশ্মি কঠিন মাধ্যমের মধ্য দিয়েও চলতে পারে এবং কালো কাগজে মোড়ানো ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর সাধারণ আলোক রশ্মির অনুরূপ কালো দাগ সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানী মাদাম কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম ধাতুর ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করেন। পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে এ ধরনের অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ এবং এক মৌলের পরমাণু অন্য মৌলের পরমাণুতে পরিণত হওয়ার ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে ।
যে ধর্মের প্রভাবে কতোগুলো ভারী মৌলের পরমাণুর অস্থায়ী নিউক্লিয়াস যেকোনো অবস্থায় নিজে থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরাম গতিতে বিভাজিত হয়ে নতুন মৌলের পরমাণুর অপেক্ষাকৃত স্থায়ী নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় এবং একই সাথে এক বিশেষ প্রকৃতির অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ ঘটায়, মৌলের এ ধর্মকে তেজষ্ক্রিয়তা বলে । যে মৌলগুলো বিরামহীনভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভাজিত হয়ে নতুন নতুন মৌল উৎপন্ন করে এবং একই সাথে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকিরিত করে সেসব মৌলকে তেজষ্ক্রিয় মৌল বলে। ভারী মৌলের অস্থায়ী নিউক্লিয়াস অবিরাম গতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভাজিত হওয়ার সময় যে অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ ঘটায় তাকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বলে।
তেজস্ক্রিয় রশ্মি (Radioactive radiations ):
1904 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড লক্ষ্য করেন সীসা খণ্ডে রাখা তেজষ্ক্রিয় রেডিয়াম থেকে যে রশ্মি বিকিরিত হয় তার সামনে চৌম্বক ক্ষেত্র অথবা তড়িৎ ক্ষেত্র স্থাপন করলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিকিরিত রশ্মি তিন দিকে বিশ্লিষ্ট হয়। বেশ কিছু রশ্মি ঋণাত্মক তড়িৎ ক্ষেত্রের দিকে অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয়, এরা o রশ্মি। কিছু রশ্মি ধনাত্মক তড়িৎ ক্ষেত্রের দিকে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয়, এরা B রশ্মি। এ ছাড়া কিছু রশ্মি কোনো দিকে বিক্ষিপ্ত না হয়ে সোজাপথে নির্গত হয়, এরা Y রশ্মি। এ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তেজষ্ক্রিয় রশ্মি তিন প্রকারের হয়। যথা :
(i) a রশ্মি, (ii) B রশ্মি, (iii) y রশ্মি
a রশ্মিগুলো ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট বিধায় এরা ঋণাত্মক তড়িৎক্ষেত্রের দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। B রশ্মিগুলো ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট বিধায় এরা ধনাত্মক তড়িৎক্ষেত্রের দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। y রশ্মিগুলো আধান নিরপেক্ষ বিধায় এরা তড়িৎক্ষেত্রের কোনো দিকেই বিক্ষিপ্ত হয় না।
আলফা রশ্মি ( রশ্মি):
প্রকৃতপক্ষে আলফা রশ্মি ধনাত্মক আধানযুক্ত অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ কণার স্রোতমাত্র। তীব্র গতিবেগ নিয়ে তেজষ্ক্রিয় মৌল থেকে বিকিরিত হওয়ার কারণে এসব পদার্থ কণাকে রশ্মি বলে মনে হয়। এ রশ্মির গতিবেগ 1.4 x 10 cms-1 থেকে 1.7 x 10 cm.st হয়। অর্থাৎ আলোর গতিবেগের এক দশমাংশের সমান।
আলফা কণা চার এককবিশিষ্ট হওয়ায় এর গতিশক্তির মান সবচেয়ে বেশি। উচ্চ ধনাত্মক আধানযুক্ত হওয়ায় গ্যাসীয় মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন করে এবং গ্যাস বেশি পরিমাণে আয়নিত হয়। সাধারণ বায়ুর মধ্যদিয়ে 7 cm দূরত্ব অতিক্রমণের পর আলফা কণার আর গতি থাকে না । শরীরের সংস্পর্শে এসে আলফা রশ্মি দগ্ধ ক্ষতের সৃষ্টি করে। এর ভেদন ক্ষমতা কম বিধায় চামড়া ভেদ করে বেশি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর কালো দাগের সৃষ্টি করে ।
বিটা রশ্মি (B রশ্মি):
বিটা রশ্মি এক একক ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ কণার সমষ্টি। তীব্র গতিবেগ নিয়ে তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে বিকিরিত হওয়ার কারণে এদের রশ্মি বলা হয়। প্রতিটি B-কণার ঋণাত্মক আধানের পরিমাণ একটি ইলেকট্রনের আধানের সমান যার মান 1.6 × 10-14C বা, 4-8 × 10- “esu. এর ভরও একটি ইলেকট্রনের ভরের সমান যার মান 9.1 × 10 kg। B রশ্মির গতিবেগ 1-12 x 10 cm.s-1 থেকে 1.53 x 10 cm. s- অর্থাৎ আলোর গতিবেগের 80-90% ।
B রশ্মির ভর কম হওয়ায় এর গতিশক্তি কম হয় এবং ভরবেগের মানও ( কণার তুলনায় কম হয়। B রশ্মি গ্যাসীয় মাধ্যমের ভেতর দিয়ে গেলে গ্যাসকে আয়নিত করে তবে at রশ্মির তুলনায় কম এবং বিপরীত আধান যুক্ত হয়। এর ভেদন ক্ষমতা a. রশ্মির তুলনায় প্রায় 50 গুণ বেশি। B রশ্মি মানবদেহের অভ্যন্তরে α অনেক ভেতরে প্রবেশ করতে পারে এবং এর ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। এটি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত করে কালো দাগের সৃষ্টি করে থাকে ।
গামা রশ্মি (y রশ্মি):
গামা রশ্মি আধান নিরপেক্ষ ও এর কোনো ভর নেই। Y রশ্মি কোনো পদার্থ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমন্বিত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিশেষ যার মধ্যে থাকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ফোটন। এটি X রশ্মির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সাধারণভাবে তেজস্ক্রিয় মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে a. রশ্মির বা B রশ্মি বিকিরণের ফলে যে অতিরিক্ত শক্তির সৃষ্টি হয় সে শক্তি আধান নিরপেক্ষ, ভরহীন, খুব কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসাবে অর্থাৎ y রশ্মির হিসাবে বিকিরিত হয়। y রশ্মি ভরবিহীন হওয়ায় এর Y গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান হয়। এ বেগের মান 3 x 108 m.s”। এর গতিশক্তির মান ও ভরবেগের মান উভয়ই শূন্য হয়।
কারণ এটি ভরহীন। এর ভেদন ক্ষমতা B রশ্মির অপেক্ষাও বেশি। ভেদন ক্ষমতা অত্যধিক বেশি হওয়ায় এ রশ্মি শরীরের অনেক ভেতরে প্রবেশ করতে পারে এবং দেহের ক্ষতিসাধন করে। তবে ফটোগ্রাফি প্লেটের উপর কম মাত্রায় কালোদাগের সৃষ্টি করে ।
a ও B কণা দুটি আধানযুক্ত কিন্তু কোনো মৌল থেকে o ও B কণা বিচ্ছুরণের ফলে মৌলের আধান নিরপেক্ষ থেকে যায়—
a কণার পরিপূর্ণ প্রকাশ ½ He2+ । কোনো মৌলের পরমাণু থেকে 1টি a কণার বিচ্ছুরণ ঘটায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে 2টি প্রোটন ও 2টি নিউট্রন কমে যায় এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে অতিরিক্ত দুটি ইলেকট্রন জমা হয়। পরমাণু এই অতিরিক্ত ইলেকট্রন দুটি পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে প্রশম অবস্থা প্রাপ্ত হয়। আবার নিউক্লিয়াসের 1টি নিউট্রন কণা ভেঙে প্রোটন ও ইলেকট্রন পরিণত হওয়ার পর, উৎপন্ন ইলেকট্রন B-কণা হিসাবে নির্গত হয়।
এ অবস্থায় নিউক্লিয়াসের বাইরের কক্ষের মোট ইলেকট্রন সংখ্যা অপেক্ষা কেন্দ্রে একটি প্রোটন অতিরিক্ত হয়। পরমাণুটি পরিবেশ থেকে একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে প্রশম অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এ কারণে তেজস্ক্রিয় মৌলের পরমাণু থেকে a. বা B কণা নির্গত হলেও উৎপন্ন পরমাণু আধান নিরপেক্ষ থেকেই যায় ।
আরও পড়ুন…