রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সতর্কতা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার” ইউনিট ৮ এর অন্তর্ভুক্ত।
রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সতর্কতা
রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সতর্কতা (Caution in storing and using chemical reagents)
পরীক্ষাগারে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ ও ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তোমরা অনেকেই জান না যে, কোনো কোনো রাসায়নিক পদার্থগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর । কিন্তু রসায়ন গবেষণাগারে গেলে তোমরা দেখবে অনেক রাসায়নিক পদার্থের বোতলের গায়ের লেবেলে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া আছে। এ সাংকেতিক চিহ্নগুলো থেকে তোমরা জানতে পারবে কোন রাসায়নিক পদার্থটি বিস্ফোরক, কোনটি বিষাক্ত ও বিপজ্জনক, কোনটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কোনটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি ।
মূলত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এদের সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়ে। এ সংক্রান্ত একটি সর্বজনীন নিয়ম চালুর জন্য ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশ ও উন্নয়ন নামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো হচ্ছে-
১। রাসায়নিক পদার্থকে ঝুঁকি ও ঝুঁকির মাত্রার ভিত্তিতে বিভক্ত করা।
২। ঝুঁকির সতর্কতা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তৈরি করা ।
৩। ঝুঁকি ও ঝুঁকির মাত্রা বোঝাবার জন্য সর্বজনীন সাংকেতিক চিহ্ন নির্ধারণ ও ব্যবহার করা।
তীব্র এসিড ও তীব্র ক্ষারক পদার্থ গায়ে চোখে মুখে পড়লে পুড়ে যায়। তাই এদের বোতলের গায়ে বিপজ্জনক সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এরকম বিস্ফোরক পদার্থ, জারক পদার্থ, দাহ্য পদার্থ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি পাত্রের গায়ে লেবেল লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সাংকেতিক চিহ্ন প্রদান করা আবশ্যক।
তাহলে ছাত্রছাত্রী বা ব্যবহারকারী সহজেই কোনো রাসায়নিক পদার্থের পাত্রের গায়ের লেবেল দেখে ঝুঁকির মাত্রা মাথায় রেখে সাবধানতার সাথে পদার্থ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করতে পারবে। কোন রাসায়নিক পদার্থ কোথায় কীভাবে সংরক্ষণ করলে রাসায়নিক দ্রব্যের মান ঠিক থাকবে ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে সেসব ধারণা পাবে। এছাড়া কোন রাসায়নিক পদার্থটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কোন পদার্থটি নিয়ে কাজ করতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, কোনটি দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
নিচে কতকগুলো রাসায়নিক পদার্থের সাংকেতিক চিহ্ন ও ঝুঁকির মাত্রা ও সাবধানতা ছক আকারে দেওয়া হলো :
কোনো রাসায়নিক পদার্থের পাত্রের লেবেল বা আলাদাভাবে সরবরাহকৃত রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপদ তথ্য শিট (Material Safty Data Sheet-MSDS) এর নির্দেশনা অনুযায়ী ঐ রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ করতে হবে। MSDS এ রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ক্ষেত্র, ব্যবহার বিধি বা প্রক্রিয়া, ব্যবহার নিষেধ ইত্যাদি তথ্য ব্যবহারকারীর জন্য দেওয়া থাকে। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্যের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি, সংরক্ষণ সতর্কতা, দাহ্যতা, তেজস্ক্রিয়তা, সক্রিয়তা ইত্যাদি তথ্য দেওয়া থাকে ।
গবেষণাগারে সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের বোতল বা পাত্রের গায়ে অনেক ক্ষেত্রে নিউমেরিক (numeric) কোড ও কালার (Colour) কোড ব্যবহার করা হয়। নিচে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

বিশেষ সতর্কতা : OX দ্বারা জারক পদার্থ, X দ্বারা বাতাসের জলীয় বাষ্প বা পানির সংস্পর্শে ক্ষতিকর হতে পারে ও X দ্বারা অন্য পদার্থের সংস্পর্শে ক্ষতিকর নির্দেশ করা হয়।
রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত কালার কোড :
লাল (Red, R) : দহনযোগ্য পদার্থ, এজন্য তাপ ও আগুন থেকে দূরে সংরক্ষণ করতে হবে।
নীল (Blue, B) : স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শ্বাসের সাথে গ্রহণে, ত্বক দ্বারা শোষিত হলে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।
হলুদ (Yellow, Y) : সক্রিয় (Reactive) এবং জারক পদার্থ। বায়ু, পানি ও অন্যান্য পদার্থের সাথে তীব্রভাবে বিক্রিয়া করতে পারে। দহনযোগ্য ও শিখা উৎপন্নকারী পদার্থ থেকে দূরে সংরক্ষণ করতে হবে।
সাদা (White, W ) : ক্ষয়কারী পদার্থ, ত্বক, চোখ ও মিউকাস পর্দার জন্য ক্ষতিকর । লাল, হলুদ ও নীল রঙের কোডকৃত দ্রব্য থেকে দূরে সংরক্ষণ করতে হবে।
ধূসর (Gray, G) : মধ্যম ক্ষতিকর পদার্থ, সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য হিসেবে সংরক্ষণ করা যায়।
ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণে কতকগুলো সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করা হয়।
যেমন—
(i) রাসায়নিক দ্রব্য কখনো খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না । বিকারক বোতলে বিকারক রেখে ছিপি বা কর্ক লাগিয়ে রাখতে হবে ।
(ii) এসিড ও ক্ষার সর্বদা ভিন্ন টেবিলে সাজিয়ে রাখতে হবে। ধূমায়িত বা গাঢ় এসিড ভিন্ন টেবিলে সাজিয়ে রাখতে হবে।
(iii) একইভাবে জারক ও বিজারক পদার্থ একই টেবিলে বা তাকে রাখা যাবে না ।
(iv) পরীক্ষার জন্য বিকারক ভিন্ন টেবিলে বর্ণের ক্রমানুসারে সাজিয়ে রাখতে হবে ।
(v) বিকারক বোতলে স্থায়িভাবে রাসায়নিক পদার্থের নাম, সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি ও সতর্ক সংকেত যুক্ত লেবেল বা MSDS লাগাতে হবে । বৃহদাকারের পাত্রগুলো শেলফের নিচে রাখতে হবে।
(vi) দাহ্য পদার্থগুলো পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। (vii) উচ্চ বিষাক্ত পদার্থ, গাঢ় তীব্র এসিড ও ক্ষার তালাবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে।
(viii) আলোক সংবেদনশীল পদার্থকে রঙিন বোতলে রাখতে হবে।
(ix) ব্যবহার মাত্রা ও পরিমাণের উপর ভিত্তি করে অধিক ব্যবহারযোগ্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারিক ডেস্কের তাকে সাজিয়ে রাখতে হবে। রাসায়নিক উপাদানকে বিন্যাসের ক্ষেত্রে ইংরেজি আদ্যক্ষরের ক্রমানুসারে সংরক্ষণ বাঞ্ছনীয় নয়। এতে পরস্পর বিপরীতধর্মী পদার্থগুলো পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে ।
(x) রাসায়নিক পদার্থের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রেকর্ড খাতায় স্টোররূপে সংরক্ষিত পদার্থের পরিমাণ, আয়ুষ্কাল, উৎপাদন তারিখ, প্রথম প্যাকেট/কর্ক খুলে ব্যবহারের তারিখ, সংরক্ষণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুন…