ব্যালান্স ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর “ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার” ইউনিট ৮ এর অন্তর্ভুক্ত।
ব্যালান্স ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার
পল-বুঙ্গি ব্যালেন্স (Paul-Bunge Balance)
মাত্রিক বিশ্লেষণের জন্য সূক্ষ্ম ও সঠিক ওজন নির্ণয় একান্ত প্রয়োজন। এজন্য এই রাসায়নিক নিক্তি (Balance) ব্যবহার করা হয়।
গঠন : একটি আয়তাকার বেদির উপর পল-বুঙ্গি ব্যালেন্স বসানো থাকে এবং নিক্তিটি একটি কাঠের ফ্রেমে আটকানো গ্লাস বক্সের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়। এই বক্সের নিচের দিকে স্পিরিট লেভেলের তিনটি লেভেলিং স্ক্রু থাকে। এই নিক্তিতে অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর সংকরের তৈরি দাগ কাটা একটি বিম (Beam) থাকে । এই বিমের দুই প্রান্তে দুটি সমন্বয়কারী স্ক্রু থাকে। এর সাহায্যে পাল্লায় কোনো ওজন বা পদার্থ না রেখে প্রয়োজনে স্ক্রু ঘুরিয়ে তুলাদণ্ডের নির্দেশক স্কেলের শূন্য বা রেস্ট বিন্দুতে স্থাপন করা হয়।
বিমের মাঝখানে একটি এবং মধ্যস্থল হতে দুই প্রান্তের দিকে সমান দূরত্বে আরও দুটি প্রিজমাকৃতির ফলক থাকে। বিমের প্রান্তে ফলক হয়ে একটি করে মোট দুটো পাল্লা ঝুলানো থাকে । এই ফলকগুলো অ্যাগেট (agate) বা কোরান্ডাম দ্বারা তৈরি। এ কারণে এতে মরিচা পড়ে না । বিমের মাঝখানের ফলকটি একটি অ্যাগেট প্লেটটের উপর প্রতিস্থাপন করা হয়। অ্যাগেট প্লেটটটি একটি দণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে। এর সাহায্যে বিমটি উঁচুনিচু করা যায়, কারণ দণ্ডটি ফাঁপা এবং এর মধ্য দিয়ে ওঠানামা করতে পারে এরূপ একটি সচল দণ্ড যুক্ত থাকে । ফাঁপা দণ্ডের গোড়ার দিকে একটি স্কেল থাকে।
নিক্তির বিমের সাথে যুক্ত একটি নির্দেশক এই স্কেলের উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে। স্কেলটির মাঝখানের দুই দিকে দশটি করে দাগ কাটা থাকে। প্রয়োজনে একটি হাতলের সাহায্যে অ্যাগেট প্লেটটকে ওঠানামা করানো যায়। নিক্তিটিকে একটি কাচের বাক্সের মধ্যে রাখা হয়, যাতে বাতাস দ্বারা ওজন কমবেশি না হয়। এই বাক্সের সামনের দিকে দরজা থাকে । যেটি খুলে পাল্লায় ওজন বা যে বস্তুর ওজন নিতে হবে সেটি বসানো যায়। সাধারণত দরজা বন্ধ করে ওজন নিতে হয়। নিক্তির নিচের তলে স্পিরিট লেভেল থাকে যার সাহায্যে নিক্তিকে সমান তলে আনা যায়।
বিমের যেকোনো দাগের উপর রাইডার বা আরোহী বসানোর ব্যবস্থা থাকে। আরোহী একটি সরু বাঁকানো তার। যে ধাতব দণ্ডের সাহায্যে তুলাদণ্ডের স্কেলের উপর দিয়ে রাইডারকে ডানে বা বামে চলাচল করানো হয় তাকে আরোহী বাহক বলে । আরোহী ব্যবহার করে পল-বুঙ্গি ব্যালেন্সের সাহায্যে চার দশমিক স্থান পর্যন্ত পদার্থের ভর নির্ণয় করা যায়।
ওজন বাক্স (Weight Box) : সঠিকভাবে ওজন নেওয়ার জন্য ওজন বাক্স ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে 1, 2, 5, 10, 20, 50, 100 গ্রামের ওজন থাকে । এছাড়া 10, 20, 50, 100, 200, 500 মিলিগ্রামের ওজন- ওজন বাক্সে রক্ষিত নির্দিষ্ট স্থানে বসানো থাকে। এছাড়া 5 অথবা 10 মিলিগ্রাম ওজনের রাইডার থাকে।
রাইডার ধ্রুবক নির্ণয় : পল-বুঙ্গি ব্যালেন্সের বাম দিকের প্রান্তে ) এবং ডান প্রান্তে 10 লেখা থাকে। এর মধ্যে সর্বমোট 100টি ভাগ থাকে। ওজন নেওয়ার সময় 10 মিলিগ্রাম রাইডারটি শূন্যে রেখে সমন্বয় স্ক্রুর সাহায্যে নির্দেশকটি স্কেলের মধ্যস্থলে আনা হয় । এরপর রাইডারটি বিমের ডান দিকে 100তম ঘরে রেখে ওজন বাম পাল্লায় নেওয়া হয়। দেখা যায় এর সমভার করার জন্য 20 মিলিগ্রাম ওজন লেগেছে।
অতএব, 100 ঘরের জন্য প্রয়োজন 20 মিলিগ্রাম = 0.02 গ্রাম
… 1 ঘরের জন্য প্রয়োজন 0-020/100 মিলিগ্রাম = 0.0002 গ্রাম
… রাইডার ধ্রুবক = 0.0002 গ্রাম
ওজন গ্রহণ : যে বস্তুর ওজন নিতে হবে সেটিকে একটি ওজন বোতলে নিয়ে নিক্তির বাম পাল্লায় রাখতে হবে। ডান পাল্লায় প্রয়োজনীয় ওজন রাখা হয় এবং দ্রব্যসহ বোতলটির ওজন নেওয়া হয়। এখন যে পরিমাণ দ্রব্য প্রয়োজন, তা অল্প অল্প করে বিকার বা আয়তনমিতিক ফ্লাস্কে নিতে হয়। পরবর্তীতে অবশিষ্ট দ্রব্যসহ বোতলের ওজন বের করা হয়। এখন প্রথম ও শেষ ওজনের পার্থক্যই বস্তুর ওজন।
ওজন মাপার পদ্ধতি : প্রথমে নিক্তিটিকে স্ক্রুর সাহায্যে লেভেল করতে হবে। এরপর রাইডার ধ্রুবক নির্ণয় করতে হবে। এরপর যে বস্তুর ওজন নিতে হবে সেটি বাম পাল্লায় রেখে ডান পাল্লায় ওজন রেখে অনড় নির্দেশকটিকে মুক্ত অবস্থায় আনতে হবে যাতে নির্দেশকটি স্কেল বরাবর উভয় দিকে দুলতে পারে এবং সমভার হওয়ার কাছাকাছি হলে রাইডার ব্যবহার করে ওজন গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তীতে যে পরিমাণ বস্তুর ওজন নিতে হবে সেই পরিমাণ বস্তু অন্য পাত্রে ঢেলে নিয়ে পুনরায় ওজন ও রাইডার ব্যবহার করে ওজন বোতলের ওজন নিতে হবে।
এই দুই ওজনের পার্থক্যই বস্তুর প্রকৃত ওজন। একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে ওজন নেওয়ার সময় যদি প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য বেশি বা কম বস্তু ওজন বোতল হতে বের করে নেওয়া হয় তবে কোনো অসুবিধা নেই। ওজনটি সঠিকভাবে নিতে হবে। ডান পাল্লায় রক্ষিত বিভিন্ন ওজন যোগ করে তার সাথে রাইডারের মান যোগ করতে হবে। নিচে একটা উদাহরণ দ্বারা বোঝানো হলো ।
ধরা যাক, একটি বস্তুর ওজন নিতে 50, 20, 2, 1 গ্রাম এবং 500, 100 মিলিগ্রাম ওজন ব্যবহার করা হলো এবং রাইডার 20 দাগ পর্যন্ত হলো। তাহলে নির্ণেয় ওজন হবে –
(50 + 20 + 2 + 1) গ্রাম + (500 + 100) মিলিগ্রাম + ( 20 × 0.0002) গ্রাম
= 73 গ্রাম + 0-600 গ্রাম + 0.0040 গ্রাম
= 73-6040 গ্রাম
ডিজিটাল ব্যালেন্স (Digital Balance)
সঠিক ও সূক্ষ্ম ভর পরিমাপের জন্য রসায়ন ল্যাবরেটরিতে ডিজিটাল ব্যালেন্স ব্যবহার করা হয়। এটি একটি একক পাল্লাবিশিষ্ট (Single pan) ব্যালেন্স। ডিজিটাল ব্যালেন্স চতুষ্কোণ বা গোলাকার হতে পারে। এই ব্যালেন্সের সাহায্যে অধিকতর সহজে ও সূক্ষ্মভাবে দ্রব্য পরিমাপ করা যায়। ডিজিটাল ব্যালেন্সে বস্তুর ওজন মনিটরে বা পর্দায় অঙ্কে (Digit) ভেসে ওঠে বা দৃশ্যমান হয়। এই ব্যালেন্স অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় এর প্যানের চারদিকে কাচের দরজা দিয়ে ঢাকা থাকে। এর মধ্যে ডান, বাম ও উপরের দরজা তিনটি স্লাইড (Slide) করে খোলা যায়। ফলে প্যানের উপর বস্তু রাখা ও বের করা সহজ হয়। দুই ধরনের ডিজিটাল ব্যালেন্স ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করা হয়। যথা- 2- ডিজিট ব্যালেন্স ও 4-ডিজিট ব্যালেন্স।
2-ডিজিট ব্যালেন্স : সাধারণ পরিমাপের জন্য দশমিকের পর 2- ডিজিট সংবলিত ব্যালেন্স ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের ব্যালেন্সের সাহায্যে 0-1-0-001 পর্যন্ত সূক্ষ্ম বা নির্ভুলভাবে ভর পরিমাপ করা যায়। সেকেন্ডারি স্ট্যান্ডার্ড পদার্থের (KMnO4, H2C2O4, KNO3, NaOH ইত্যাদি) ভর মেপে দ্রবণ প্রস্তুতি ও সাধারণ বিকারক (AgNO, দ্রবণ, ফেহলিং দ্রবণ, টলেন বিকারক ইত্যাদি) প্রস্তুতিতে যেক্ষেত্রে সূক্ষ্ম পরিমাপের প্রয়োজন হয় না সেক্ষেত্রে এ ব্যালেন্স ব্যবহৃত হয়।
কার্যপদ্ধতি : প্রথমে ব্যালেন্সটিকে পরিষ্কার ও সমতল জায়গায় বসিয়ে সামনের কাচের জানালা বা ডিসপ্লে (Display) জানালা উপরে উঠানো হয়। ব্যালেন্সের সুইচ অন করে বস্তু ধারক পাত্র (বিকার, মসৃণ কাগজ, ওজন বোতল ইত্যাদি) রেখে Tare সুইচ বা Calibarate switch চাপ দিলে ডিসপ্লেতে 0-00 দেখায়। এরপর পাত্রে প্রয়োজনমতো বস্তু নিয়ে ভর মাপা হয়।
4-ডিজিট ব্যালেন্স : যেসব ক্ষেত্রে খুব অল্প পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান পরিমাপের ক্ষেত্রে অতি সংবেদনশীল 4-ডিজিট ব্যালেন্স ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের মাইক্রো অ্যানালিটিক্যাল ব্যালেন্সের সাহায্যে 0-0001 g বা 10mg এর দশ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত ভর সূক্ষ্ম বা নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায়। প্রাইমারি স্ট্যান্ডার্ড পদার্থ (Na2CO3 (শুষ্ক), K2Cr2O7, H2C2O4.2H2O ইত্যাদি) পরিমাপ করে প্রমাণ দ্রবণ প্রস্তুতিতে এই ব্যালেন্সে, ভর নেওয়া হয়। এই ব্যালেন্সের কার্যপদ্ধতি 2-ডিজিট ব্যালেন্সের অনুরূপ। এক্ষেত্রে ডিসপ্লে জানালা অবশ্য বন্ধ রাখতে হয়, যাতে বায়ুপ্রবাহ বা ধুলিকণা এক্ষেত্রে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না করে ।
ডিজিটাল ব্যালেন্স ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে— যে কেউ এ ব্যালেন্সের সাহায্যে সঠিক ও নির্ভুলভাবে ভর পরিমাপ করতে পারে। যেখানে বাতাস চলাচলে অন্য নিক্তির সাহায্যে ভর মাপলে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে ডিজিটাল ব্যালেন্সের চারদিকে গ্লাস দ্বারা ঘেরা থাকায় এ ধরনের ত্রুটি হয় না।
আরও পড়ুন…