হাইড্রোজেন বর্ণালী

হাইড্রোজেন বর্ণালী আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “পারমাণবিক গঠ” ইউনিট ১ এর অন্তর্ভুক্ত

 

হাইড্রোজেন বর্ণালী

 

বোর পরমাণু মডেল ও হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালি (Bohr Atom Model & Atomic Spectrum of Hydrogen):

পারমাণবিক বর্ণালি (Atomic Spectrum):

সূর্যরশ্মিকে সরু ছিদ্রপথে একটি প্রিজমের ভিতর দিয়ে চালনা করলে তা প্রিজম দ্বারা বিচ্ছুরিত হয়ে বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হয়। এরূপ বিভিন্ন বর্ণের সমাবেশকে বর্ণালি ( spectrum) বলে। প্রকৃতিতেও বর্ণালি সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যেমন– রংধনু। ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে অন্য কোনো শক্তিস্তরে গমনের ফলে আলোকরশ্মি হিসেবে শক্তি শোষিত বা বিকিরিত হয়। আলোর এ বিকিরণ বা শোষণের ফলে বর্ণালির সৃষ্টি হয়।

যদি ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তর হতে নিম্ন শক্তিস্তরে পতিত হয় তবে শক্তির বিকিরণ ঘটে এবং এক্ষেত্রে উজ্জ্বল রেখা পাওয়া যায়। একে বিকিরণ বর্ণালি (Emission spectrum) বলে। আবার ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর হতে উচ্চ শক্তিস্তরে গমন করলে শক্তির শোষণ ঘটে। এক্ষেত্রে কালো বর্ণালি রেখা পাওয়া যায়। একে শোষণ বর্ণালি (Absorption spectrum) বলে। শোষণ বা বিকিরণ বর্ণালির সাহায্যে কোনো পদার্থকে শনাক্ত করা যায়।

কোনো গ্যাস বা বাষ্পকে উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে বা এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ চালনা করলে যে বর্ণালি উৎপন্ন হয় তাকে বিকিরণ বর্ণালি (Emission spectrum) বলে। এ বিচ্ছুরণ বর্ণালিতে কতকগুলো একক রেখা পাওয়া যায়, তাকে রেখা বর্ণালি (line spectrum) বলে। রেখা বর্ণালিগুলো পরমাণু হতে উৎপন্ন হয় বলে এদেরকে পারমাণবিক বর্ণালি (Atomic spectrum) বলা হয়।

 

মনে রাখবেন : রেখা বর্ণালি ও পারমাণবিক বর্ণালির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই :

H পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা 1। তাই H পরমাণুতে একটি মাত্র ইলেকট্রন বর্তমান। বোরের তত্ত্বানুসারে সাধারণ অবস্থায় H পরমাণুর একটি মাত্র ইলেকট্রন আবর্তনশীল অবস্থায় সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে বা K কক্ষে (n = 1 ) অবস্থান করে থাকে। কিন্তু বাইরের থেকে কোনো শক্তি যেমন তাপ বা আলো শোষণ করে হাইড্রোজেন পরমাণুটি তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে উত্তেজিত অবস্থায় এলে ওর K কক্ষের ইলেকট্রনটি উচ্চতর শক্তিবিশিষ্ট যেকোনো কক্ষে যেমন, L ( n = 2 ) বা M ( n = 3 ) বা, N (n = 4 ) কক্ষে চলে যেতে পারে ।

এভাবে কিছু পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাসে উপস্থিত ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ শক্তি শোষণ করে এবং তাদের ইলেকট্রনগুলো ভিন্ন ভিন্ন শক্তিস্তরে উন্নীত হয়। এবার বাহ্যিক শক্তির উৎস সরিয়ে নিলে ঐ ইলেকট্রনগুলো উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে শক্তি বর্জন বা ত্যাগ করে নিম্নতর শক্তিস্তরের যেকোনো স্তরে লাফিয়ে পড়ে। ফলে নির্গত শক্তি বর্ণালিতে রেখা আকারে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে নিম্নতর শক্তি স্তরে ইলেকট্রনের প্রত্যাবর্তনের ফলে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের শক্তি বিকিরণ করে থাকে । এ কারণে হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি মাত্র ইলেকট্রন থাকা সত্ত্বেও এর পারমাণবিক বর্ণালিতে অনেকগুলো বিশেষ করে ছয়টি রেখা বর্ণালি দেখা যায়।

সকল পদার্থই বিদ্যুৎক্ষরণের প্রভাবে বা উচ্চতাপে উত্তেজিত অবস্থায় বিকিরণ বর্ণালি সৃষ্টি করে। মৌলের পারমাণবিক বিকিরণ বর্ণালি দৃশ্যমান ও অতিবেগুনি অঞ্চলে লক্ষ করা যায়। যেমন, সোডিয়াম বা সোডিয়াম লবণ (NaCl) দীপশিখায় ধরলে 590 nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে এবং দীপশিখাকে হলুদ বর্ণ প্রদান করে। কাচনলে হাইড্রোজেন গ্যাসকে বিদ্যুৎক্ষরণের সাহায্যে উত্তেজিত করলে এ গ্যাস লাল আলোয় দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎক্ষরণে হাইড্রোজেন অণু ভেঙে হাইড্রোজেন পরমাণুতে পরিণত হয় । হাইড্রোজেন পরমাণু লাল দীপ্তিময় আলো উৎপন্ন করে ।

 

হাইড্রোজেনের পারমাণবিক বর্ণালি (Atomic spectrum of Hydrogen) :

একটি কাচনলে নিম্নচাপে হাইড্রোজেন গ্যাস রেখে এতে উচ্চ মাত্রার বিদ্যুৎ ক্ষরণ ঘটালে হাইড্রোজেন পরমাণু হতে গোলাপি বর্ণের আলোর বিকিরণ ঘটে। এ বিকিরিত আলোকে স্পেকট্রোস্কোপের প্রিজমের মধ্য দিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটে ফেললে হাইড্রোজেনের বিকিরণ বর্ণালিতে অনেকগুলো রেখার পৃথক পৃথক সিরিজ বা শ্রেণি পাওয়া যায়। এ বর্ণালি রেখার সমাহারকে হাইড্রোজেনের রেখা বর্ণালি বা পারমাণবিক বর্ণালি বলে ।

 

হাইড্রোজেন বর্ণালী

 

হাইড্রোজেন বর্ণালির ব্যাখ্যা (Explanation of Atomic Spectrum of Hydrogen):

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে বিজ্ঞানী বোর হাইড্রোজেন বর্ণালির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। হাইড্রোজেন গ্যাসে নিম্ন চাপে উচ্চমাত্রায় বিদ্যুৎক্ষরণ ঘটলে হাইড্রোজেন অণু (H2) হাইড্রোজেন পরমাণুতে (H) বিভাজিত হয়ে পড়ে। এ হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো বিভিন্ন মাত্রায় শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হয়। উত্তেজিত হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন, শোষিত শক্তির মাত্রার উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিস্তরে গমন করে। শক্তির উৎস সরিয়ে নিলে উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসে।

উচ্চ শক্তিস্তর হতে যদি ইলেকট্রন ১ম শক্তিস্তরে ফিরে আসে তবে বর্ণালিতে যে রেখাসমূহ পাওয়া যায় তাকে লাইম্যান সিরিজ বলে। অনুরূপভাবে ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শক্তিস্তরে ইলেকট্রন ফিরে আসা রেখার সারিকে যথাক্রমে বামার, প্যাশ্চেন, ব্র্যাকেট ও ফান্ড সিরিজ বলে। এই সিরিজগুলো রিডবার্গ সমীকরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। নিম্নে বিডবার্গ সমীকরণটি প্রতিপাদন করা হলো— ধরি, হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন E, শক্তিস্তর থেকে শক্তি শোষণ করে উচ্চতর শক্তিস্তর E2-তে গমন করে। শক্তির উৎস সরিয়ে নিলে শক্তি বিকিরণ করে নিম্নতর শক্তিস্তরে প্রত্যাবর্তন করে এবং নির্দিষ্ট তরঙ্গ (7) এর আলো বিকিরণ করে। ফলে দুই শক্তিস্তরের পার্থক্য থেকে তা বের করা যায়-

 

হাইড্রোজেন বর্ণালির ব্যাখ্যা

হাইড্রোজেন বর্ণালির ব্যাখ্যা

 

প্রতিটি সিরিজেই ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির সাথে রেখাগুলো ক্রমশ নিকটবর্তী হতে থাকে। এ সিরিজগুলোর বর্ণালি রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিম্নের সমীকরণ হতে গণনা করা যায়—

 

 

এই সমীকরণ ব্যবহার করে হাইড্রোজেন বর্ণালির বিভিন্ন সিরিজের বর্ণালি রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যায়।

হাইড্রোজেন বর্ণালির দৃশ্যমান অঞ্চলের জন্য n = 2 এবং RH = 109678 cm” এবং n2 = 3, 4, 5 ধরে ১ম, ২য় এবং ৩য় বর্ণালি রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিম্নরূপে নির্ণয় করা হয় ।

 

হাইড্রোজেন বর্ণালি

হাইড্রোজেন বর্ণালি

 

(ক) লাইম্যান সিরিজ (Lyman Series) :

বিজ্ঞানী লাইম্যান 1916 খ্রিষ্টাব্দে এ সিরিজ আবিষ্কার করেন। এক্ষেত্রে উত্তেজিত অবস্থায় হাইড্রোজেন পরমাণুর উচ্চতর শক্তিস্তর হতে ইলেকট্রন প্রথম শক্তিস্তরে গমন করে। হাইড্রোজেন বর্ণালির অতিবেগুনি (UV) অঞ্চলে এ সিরিজ উদ্ভব হয় ।

লাইম্যান সিরিজ

 

খ) বামার সিরিজ (Balmer Series) :

বিজ্ঞানী বামার 1885 খ্রিষ্টাব্দে এ সিরিজ আবিষ্কার করেন। হাইড্রোজেন পরমাণুর দৃশ্যমান (Visible) অঞ্চলে এ সিরিজের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন উত্তেজিত অবস্থায় যেকোনো উচ্চতর শক্তিস্তর হতে দ্বিতীয় শক্তিস্তরে গমন করে ।

বামার সিরিজ

 

গ) প্যাশ্চেন সিরিজ (Paschen Series) :

বিজ্ঞানী প্যাশ্চেন 1908 খ্রিষ্টাব্দে এ সিরিজ আবিষ্কার করেন। হাইড্রোজেন বর্ণালির অবলোহিত অঞ্চলে এ সিরিজের উদ্ভব ঘটে। এক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পরমাণুর উত্তেজিত ইলেকট্রন উচ্চতর যেকোনো শক্তিস্তর হতে তৃতীয় শক্তিস্তরে গমন করে ।

 

প্যাশ্চেন সিরিজ

 

(ঘ) ব্র্যাকেট সিরিজ (Bracket Series) :

বিজ্ঞানী ব্র্যাকেট ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এ সিরিজ আবিষ্কার করেন। অবলোহিত অঞ্চলে এ সিরিজের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে উত্তেজিত অবস্থায় হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন উচ্চতর যেকোনো শক্তিস্তর হতে চতুর্থ শক্তিস্তরে গমন করে ।

 

ব্র্যাকেট সিরিজ

 

(ঙ) ফান্ড সিরিজ (Fund Series) :

বিজ্ঞানী ফান্ড 1929 খ্রিষ্টাব্দে এ সিরিজ আবিষ্কার করেন। হাইড্রোজেন বর্ণালির অবলোহিত অঞ্চলে এ সিরিজের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে উত্তেজিত অবস্থায় হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন উচ্চতর যেকোনো শক্তিস্তর হতে পঞ্চম শক্তিস্তরে গমন করে।

 

ফান্ড সিরিজ

 

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMO2Dtgsw-p7NAw?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en

 

বর্নালিমিতি – ১ ( বর্নালি ) :

 

রিডবার্গ সমীকরণ এর গাণিতিক সমস্যা :

 

আরও পড়ুন…

Leave a Comment