রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা

রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “রাসায়নিক পরিবর্তন” ইউনিট ৫ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা

ভরক্রিয়া সূত্র ও সূত্রের প্রয়োগ (Law of mass action and application of the law)

পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবেগ বিক্রিয়ক পদার্থের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ বিক্রিয়কের সক্রিয় ভরের উপর নির্ভর করে। বিক্রিয়ক পদার্থ একাধিক হলে বিক্রিয়ার গতিবেগ প্রতিটি বিক্রিয়কের সক্রিয় ভরের উপর নির্ভর করে। বিক্রিয়কের সক্রিয় ভর যত বেশি হয় বিক্রিয়ার গতিবেগ তত অধিক হয়। বিক্রিয়কের সক্রিয় ভর কম হলে বিক্রিয়ার গতিবেগও কম হয়। উভমুখী বিক্রিয়া পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার গতিবেগের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হয় ।

বিজ্ঞানী জি. ডব্লিউ. গুল্ডবার্গ (G. W. Guldberg) ও পি, ভাগে (P. waage) রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবেগ সংক্রান্ত একটি সূত্র প্রতিষ্ঠিত করেন যা ভরক্রিয়া সূত্র নামে পরিচিত।

“নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার বিক্রিয়ক পদার্থগুলোর প্রতিটির সক্রিয় ভরের সমানুপাতিক।”

সক্রিয় ভর : কোনো বিক্রিয়কের সক্রিয় ভর বলতে সাধারণভাবে বিক্রিয়কের মোলার ঘনমাত্রাকে বোঝায়। মোলার ঘনমাত্রাকে মোল লিটার বা গ্রাম-অণু লিটার ‘ এককে প্রকাশ করা হয়। উপাদানের সক্রিয় ভরকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। যেমন—

i. দ্রবণের ক্ষেত্রে বিক্রিয়কগুলোর সক্রিয় ভর হবে এদের নিজ নিজ মোলার ঘনমাত্রার সমান।

ii. গ্যাস মিশ্রণে কোনো উপাদানের সক্রিয় ভরকে এই উপাদানের আংশিক চাপের সাহায্যে সাধারণত প্রকাশ করা হয়।

iii. বিশুদ্ধ কঠিনের সক্রিয় ভরকে সব সময় একক ধরা হয়।

ভরক্রিয়া সূত্রকে যদি গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা হয় তবে সেক্ষেত্রে অতি সাধারণ সমীকরণ—

মনে করি, A ও B দুটি বিক্রিয়কের প্রতিটির একটি করে অণু বিক্রিয়া করে উৎপাদ C ও D এর একটি করে অণু উৎপন্ন করে ।

সেক্ষেত্রে রাসায়নিক সমীকরণটি—

A+ B → C + D

বিক্রিয়ার কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে A ও B এর সক্রিয় ভর যথাক্রমে [A] ও [B]। সুতরাং ভরক্রিয়া সূত্রানুসারে কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এই মুহূর্তে বিক্রিয়ার হার R ∝ [A] যখন [B] স্থির এবং R ∝ [B] যখন [A] স্থির ।

.:. R [A] × [B]. যখন [A] ও [B] উভয়েই পরিবর্তনশীল।

বা, R = k [A] × [B]

এখানে k = বিক্রিয়ার বেগ ধ্রুবক বা হার ধ্রুবক ।

নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী উপাদানগুলোর প্রত্যেকের সক্রিয় ভর এক একক হলে বিক্রিয়াটির যে হার হয় তাকে ওই তাপমাত্রায় ওই রাসায়নিক বিক্রিয়াটির হার ধ্রুবক বলা হয়।

উভমুখী বিক্রিয়ার সম্মুখ বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো বিশেষ মুহূর্তে সম্মুখ বিক্রিয়ার হার বিক্রিয়ক উপাদানগুলোর প্রত্যেকের সক্রিয় ভরের সমানুপাতিক। একইভাবে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো বিশেষ মুহূর্তে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার উৎপাদ পদার্থগুলোর প্রত্যেকের সক্রিয় ভরের সমানুপাতিক হয়। একটি সাধারণ উভমুখী বিক্রিয়া

A + B → C + D

এ উভমুখী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিক্রিয়াটির কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে A ও B বিক্রিয়ক দুটির সক্রিয় ভর যথাক্রমে [A] ও [B] এবং C ও D উৎপাদ দুটির সক্রিয় ভর [C] ও [D] । যদি ওই বিশেষ মুহূর্তে সম্মুখ বিক্রিয়ার হার R এবং পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার R হয়।

সুতরাং ভরক্রিয়া সূত্রানুসারে

সম্মুখ বিক্রিয়ার হার, Roc [A] × [B].

বা, R = kr [A] × [B].

পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার, Rg ∝ [C] × [D].

বা, R = kh [C] × [D].

এখানে k হলো সম্মুখ বিক্রিয়ার হার ধ্রুবক এবং ky হলো পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার ধ্রুবক।

ভরক্রিয়া সূত্রের প্রয়োগ দ্বারা সাম্য ধ্রুবক নির্ণয়

মনে করি, A + B = C + D একটি সাধারণ উভমুখী বিক্রিয়া।

বিক্রিয়ার শুরুতে বিক্রিয়ক A ও B এর ঘনমাত্রা সবচেয়ে বেশি এবং উৎপাদ C ও D এর ঘনমাত্রা শূন্য। ফলে বিক্রিয়ার শুরুতে সম্মুখ বিক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি এবং পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার শূন্য হয়। সম্মুখ বিক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সময়ের সাথে A ও B এর ঘনমাত্রা কমতে থাকে এবং C ও D এর ঘনমাত্রা বাড়তে থাকে।

A ও B এর ঘনমাত্রা কমতে থাকায় সময়ের সাথে সাথে সম্মুখ বিক্রিয়ার হার কমতে থাকে এবং C ও D এর ঘনমাত্রা বাড়তে থাকায় পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার বাড়তে থাকে। এভাবে বিক্রিয়াটি চলতে থাকলে এমন একটা সময় আসে যখন A ও B এর ঘনমাত্রা কমে সম্মুখ বিক্রিয়ার হার এবং C ও D এর ঘনমাত্রা বেড়ে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার সমান হয়ে যায়। এ অবস্থাকে উভমুখী বিক্রিয়াটির রাসায়নিক সাম্যাবস্থা বলে ।

উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়াটির সাম্যাবস্থায় A ও B বিক্রিয়ক উপাদান দুটির সক্রিয় ভর যথাক্রমে [A] ও [B] এবং C ও D উৎপাদ উপাদান দুটির সক্রিয় ভর যথাক্রমে [C] ও [D]

সাম্যাবস্থায় সম্মুখ বিক্রিয়ার হার, R = পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার, Rh.

ভরক্রিয়া সূত্র প্রয়োগ করে, সম্মুখ বিক্রিয়ার হার, Roc [A] × [B]

রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা

 

বিভিন্ন উভমুখী সাম্য বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিক্রিয়ক ও উৎপাদের বিভিন্ন ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তিকরে বিভিন্নভাবে সাম্য ধ্রুবককে প্রকাশ করা হয় । এক্ষেত্রে সাম্য ধ্রুবকগুলোকে তিনভাবে প্রকাশ করা হয় । এরা হলো Ke, Kp ও Kx।

সাম্য ধ্রুবক K এর প্রকাশ

i. কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ককে উৎপাদের সক্রিয় ভরকে এদের মোলার ঘনমাত্রা প্রকাশ করলে যে সাম্য ধ্রুবক পাওয়া যায় তাকে K. দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

ii. কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের সক্রিয় ভরকে এদের আংশিক চাপ দ্বারা প্রকাশ করলে যে সাম্য ধ্রুবক পাওয়া যায় তাকে Kp দ্বারা প্রকাশ করা হয় ।

iii. কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের সক্রিয় ভরকে এদের মোল ভগ্নাংশ দ্বারা প্রকাশ করে যে সাম্য ধ্রুবক পাওয়া যায় তাকে K, দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

তবে গ্যাসীয় উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্য ধ্রুবককে Ke, ও Kp ও K, এ তিনভাবেই প্রকাশ করা যায় । দ্রবণে দ্রবীভূত উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্য ধ্রুবককে শুধু Ka ও K এ দুইভাবে প্রকাশ করা যায়।

উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া যাক । মনে করি, কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়া সাম্যাবস্থায় অবস্থান করছে।

এ উভমুখী বিক্রিয়ার সমীকরণটি—

aA + bB → C + dD

যদি সাম্যাবস্থায় A, B, C ও D এর মোলার ঘনমাত্রা অর্থাৎ সক্রিয় ভর যথাক্রমে [A], [B], [C] ও [D] হয়।

প্রথমত :

কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় পূর্ণ বিক্রিয়ার সমীকরণ অনুযায়ী অণুসংখ্যার ঘাতে উন্নীত প্রতিটি উৎপাদের সক্রিয় ভরের গুণফল এবং পূর্ণ সমীকরণ অনুযায়ী অণুসংখ্যার ঘাতে উন্নীত প্রতিটি বিক্রিয়কের সক্রিয় ভরের গুণফলের অনুপাত একটি ধ্রুবক সংখ্যা। এ ধ্রুবক সংখ্যাকে ওই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়াটির সাম্য ধ্রুবক বলে ।

দ্বিতীয়ভাবে প্রকাশ করলে :

কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় সম্মুখ বিক্রিয়ার হার ধ্রুবক ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার ধ্রুবকের অনুপাত একটি ধ্রুবক সংখ্যা। এ ধ্রুবক সংখ্যাকে ওই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওই উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্য ধ্রুবক বলে।

রাসায়নিক সাম্যাবস্থার বৈশিষ্ট্য (Characteristic of Chemical Equilibrium)

i. স্বায়িত্ব :

সাম্যাবস্থায় বাহ্যিক শর্তগুলো যেমন তাপমাত্রা, চাপ, প্রভাবক ইত্যাদি অপরিবর্তিত থাকলে সময়ের সাথে সাম্যাবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। অর্থাৎ বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ঘনমাত্রা অপরিবর্তিত থাকে ।

ii. সাম্যাবস্থায় শর্তের পরিবর্তন :

বাহ্যিক শর্তগুলোর যেমন তাপমাত্রা, চাপ, প্রভাবক এর মধ্যে যেকোনো একটি বা একের অধিক শর্তের পরিবর্তন ঘটলে উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার স্থায়িত্ব বিঘ্নিত হয়। ফলে সময়ের সাথে সাথে বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ঘনমাত্রার পরিবর্তন ঘটে ।

iii. সাম্যাবস্থার গতিশীলতা :

কোনো উভমুখী বিক্রিয়া সাম্যাবস্থায় উপনীত হলেও বিক্রিয়াটি থেমে থাকে না। সম্মুখ বিক্রিয়া ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়া সমহারে অনবরত একই সাথে চলতে থাকে। ফলে সময়ের সাথে সাথে বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ঘনমাত্রার কোনো পরিবর্তন হয় না ।

iv. বিক্রিয়ায় অসম্পূর্ণতা :

কোনো উভমুখী বিক্রিয়ার সম্মুখ বিক্রিয়ায় হার ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার যখন সমান হয় তখন বিক্রিয়াটি সাম্যাবস্থায় উপনীত হয় । সাম্যাবস্থায় সম্মুখ বা পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার কোনো একটি যদি 100% সম্পূর্ণ হয়, তবে সাম্যাবস্থার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না ।

v. সাম্যাবস্থায় উপনীত হওয়ার সময় :

বিভিন্ন উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সাম্যাবস্থায় উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ের প্রয়োজন হয়। উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সম্মুখ বিক্রিয়ার গতিবেগ ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার গতিবেগ তথা বিক্রিয়ার হার বেশি হলে ওই উভমুখী বিক্রিয়াটি খুব দ্রুত সাম্যাবস্থায় উপনীত হয়। আর যদি সম্মুখ বিক্রিয়ার গতিবেগ ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার কম হয় তবে সেক্ষেত্রে উভমুখী বিক্রিয়াটির সাম্যাবস্থায় উপনীত হতে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়।

vi. সাম্যাবস্থাকে উভয়দিক থেকে অর্জন করা যায় :

কোনো একটি নির্দিষ্ট উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিক্রিয়ক নিয়ে বিক্রিয়া শুরু করলে যে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হয়, উৎপাদ নিয়ে বিক্রিয়া শুরু করলে ওই একই সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হয়।

(vii) প্রভাবকের প্রভাব :

প্রভাবকের উপস্থিতিতে কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্দিষ্ট বাহ্যিক শর্তে প্রভাবকের অনুপস্থিতিতে কোনো উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ঘনমাত্রা যদি একই শর্তে প্রভাবকের উপস্থিতিতে ওই একই উভমুখী রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ঘনমাত্রা একই থাকে তবে প্রথম ক্ষেত্রে বিক্রিয়াটি সাম্যাবস্থায় উপনীত হতে যে সময়ের প্রয়োজন হয় প্রভাবকের উপস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের প্রয়োজন হয় ।

 

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMO2Dtgsw-p7NAw?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en

 

রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনের উপায় নিয়ে বিস্তারিত ঃ

 

আরও পড়ুন…

Leave a Comment