UV ও IR রশ্মির ব্যবহার এবং MRI পরীক্ষা

UV ও IR রশ্মির ব্যবহার এবং MRI পরীক্ষা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “পারমাণবিক গঠ” ইউনিট ১ এর অন্তর্ভুক্ত

 

UV ও IR রশ্মির ব্যবহার এবং MRI পরীক্ষা

 

জাল পাসপোর্ট/টাকা শনাক্তকরণে UV রশ্মির ব্যবহার (Use of UV radiation to detect false Passport and Money)

বিগত শতাব্দী ধরে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে টাকা তৈরির নিরাপত্তা অপেক্ষাকৃত সুনিশ্চিত হওয়ার ফলে জাল নোট তৈরিকারকদের জন্য টাকা তৈরি করা ক্রমেই দুরূহ হয়ে পড়ছে। জাল নোট তৈরিতে বাধা প্রদান করার একটা পদ্ধতি হচ্ছে UV ফ্লুরোসেন্ট বস্তু টাকা প্রস্তুতকারী কাগজে সংযোজন করা। জাল নোট শনাক্তকারী UV মেশিনে সাধারণত টাকার কাগজের বিশেষ কালি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দৃষ্টিগোচর হয় ।

একটি জাতির প্রচলিত মুদ্রা UV নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য কৃতকার্যতার সাথে প্রয়োগ একটি দুই স্তরবিশিষ্ট পদ্ধতি। প্রথম ধাপ হচ্ছে কাগজের নোটে অতিবেগুনি (ultraviolet) কালি প্রয়োগ। UV ফ্লুরোসেন্ট ফসফরাসযুক্ত নোট যখন UV রশ্মিতে স্থাপন করা হয় তখন এটি বিক্রিয়া দেখায় যা সাধারণ আলোয় দেখা যায় না। যখন UV রশ্মিতে অনাবৃত করা হয় তখন UV কালির পরিবর্তন সংঘটিত করে এবং বিশেষ নিরাপত্তা চিহ্নগুলো মানুষের চোখে দৃশ্যমান হয়। এর অর্থ হচ্ছে সাধারণ আলোতে UV কালি দ্বারা ছাপাকৃত নিরাপত্তা নকশা প্রতীয়মান হয় না । UV আলো প্রয়োগ করলে এ পরিবর্তন পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয়, যা ফ্লুরোসেন্ট আলো সৃষ্টি করে ।

UV ও IR রশ্মির ব্যবহার

 

উল্লেখ্য যে, কাগজের মুদ্রা ছাড়া এই UV কালি পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ট্রাভেলারস চেক, সোসাল সিকিউরিটি কার্ড ইত্যাদিতে ব্যবহার করে একইভাবে জাল প্রতিরোধ করা যায়।

 

চিকিৎসা ক্ষেত্রে IR রশ্মির ব্যবহার (Use of IR radiation in The Field of Medical Science):

অবলোহিত প্রযুক্তি (infrared technology) চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অবলোহিত আলোর কারণে যে তাপ তৈরি হয় তা আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অবলোহিত ডিভাইসের সাহায্যে ক্ষতপূরণে এবং মাংসপেশিতে গরমজনিত ক্ষতের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়। অধিকন্তু, থারমোগ্রাফির জন্য যে যন্ত্রের নকশা করা হয়েছে তার সাহায্যে মানুষের শরীরে অনাচ্ছাদিত অভ্যন্তরীণ টিস্যু যা জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ সেখানে অবলোহিত রশ্মি পাঠানো সম্ভব।

বৈশিষ্ট্য : অবলোহিত রশ্মি একটি তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তুলনায় দীর্ঘ, কিন্তু রেডিও তরঙ্গের তুলনায় ছোট। খালি চোখে এটি দৃশ্যমান নয় কিন্তু এর তাপের প্রভাব অনুভব করা যায়। যেকোনো ধরনের বিকিরণ আমরা তাপ হিসেবে অনুধাবন করি এবং এ তাপ সূর্য, আগুন অথবা বাল্বের আলো হতে অবলোহিত রশ্মির সাহায্যে বিচ্ছুরিত হয়। মানব শরীরে চামড়ার পৃষ্ঠতলে ২-৩ সেন্টিমিটার গভীর করে ভেদ করতে পারে। এ রশ্মির একটি বিশেষ পার্থক্যের লক্ষণ হচ্ছে যে, সৌর বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব ব্যতিরেকে সূর্যের সাধারণ রশ্মির সব সুবিধা রয়েছে।

ব্যবহার : অবলোহিত রশ্মি ছোটখাটো সমস্যা যেমন- ব্রণ এবং মারাত্মক অসুখ, যেমন— ক্রোনিক আর্থারাইটিক ব্যথা বা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় । কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার নিম্নে প্রদত্ত হলো :

(১) ব্রণ হতে আরোগ্য লাভ : যখন অবলোহিত রশ্মি ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, ত্বকের কোষের ATP (এডিনোসাইন ট্রাইফসফেট, একটি অণু যা রাসায়নিক শক্তি পরিপাক প্রক্রিয়াকরণে কোষের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়) ত্বকের ছিদ্রের মধ্যে উপস্থিত জীবাণুগুলোকে নষ্ট করার জন্য ত্বরান্বিত হয় এবং ব্রণ ভালো হয়ে যায় ।

(২) স্থায়ী ব্যথা লাঘব : আর্থারাইটিসের ফলে প্রাপ্ত ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা অথবা মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার চিকিৎসা এই থেরাপির সাহায্যে করা হয়। ব্যথার জায়গায় যখন এটি প্রবেশ করানো হয় তখন শক্ত পেশি নরম হয়ে যায় এবং সেই সাথে ব্যথা উপশম হয় ।

(৩) খেলাধুলার ফলে প্রাপ্ত ক্ষতের উপশম : ক্রীড়াবিদদের শিরার কোষে ক্ষত বা মোচড়ানোর ফলে বিরামহীন ব্যথা হয়, আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ক্ষত হয় বা ফুলে যায়। এই রশ্মি শিরার নিকটবর্তী অংশে ব্যথা উপশম করে এবং পিটুইটারি গ্লান্ডকে (gland) উত্তেজিত করে যা শরীর হতে এনডরফিন (endorphins) নির্গত করে। এনডরফিন সাধারণভাবে প্রাকৃতিক ব্যথা নিরাময়ে কাজ করে । এনডরফিন নির্গমনের ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যথা দূর করে ।

(৪) ডায়াবেটিক ক্ষত পূরণ : ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা কম থাকে । এর কারণ তাদের ইনসুলিন নির্ভরশীল রক্ত পাত্র (blood vessel) নাইট্রিক অক্সাইডে অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল হয়। এজন্য বাইরের আঘাতের কারণে তাদের ক্ষত পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। অবলোহিত রশ্মি নাইট্রিক অক্সাইডের নির্গমন ত্বরান্বিত করে। ফলে রক্ত প্রবাহের উন্নতি ঘটে। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির কারণে ক্ষত তাড়াতাড়ি পূরণ হয় বা ভালো হয়ে যায় ।

(৫) উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনা : উচ্চ রক্তচাপের ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হতে পারে এবং মানুষের জীবন মৃত্যু ঝুঁকির দিকে যায়। যখন কোনো ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপে ভোগে তখন সমস্ত শরীরে ঠিকভাবে রক্ত সরবরাহের জন্য হার্টকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। অবলোহিত রশ্মি প্রয়োগের ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তকে পাম্প করার জন্য হার্টকে অতিরিক্ত চাপ নিতে হয় না। ফলে রক্তচাপ কমে যায় ।

 

উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনা

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া : একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করলে এই থেরাপিকে সবচেয়ে নিরাপদ বিবেচনা করা হয়। এ পর্যন্ত গবেষকরা এই চিকিৎসায় বড় ধরনের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখতে পাননি। এই রশ্মির সাহায্যে চিকিৎসাধীন রোগীর কিছু কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন— দুশ্চিন্তা, অবসাদ, উন্মত্ততা ইত্যাদি। এ ধরনের মেজাজের পরিবর্তন সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

সতর্কতা : ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, এ চিকিৎসায় বড় ধরনের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। যাহোক অবলোহিত রশ্মি কোনো রোগীকে দেওয়ার পূর্বে তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা দরকার। কিছু কিছু শারীরিক অবস্থায় এ চিকিৎসা করা কঠোরভাবে নিষেধ আছে।

(১) যদি রোগীর চক্ষু ফটো বিষক্রিয়ায় (photo toxicity) সংবেদনশীল হয়।

(২) যদি কোনো রোগীর অতীত ইতিহাসে মেজাজের বিশৃঙ্খলতা থাকে, যেমন- – উন্মত্ততা (mania)।

(৩) রোগীর ত্বক যদি ফটো সংবেদনশীল হয়।

(৪) রোগী যদি ফটো সংবেদনশীল ঔষধ গ্রহণ করে ।

(৫) রোগী যদি জন্মসূত্রে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা (disorder), যেমন- পরফিরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

রোগ নির্ণয়ে MRI পরীক্ষার মূলনীতি (Principle of MRI to detect diseases):

মানব শরীরের নরম কলার (soft tissue) উন্নত মানের প্রতিচ্ছবি (image) গঠন করে রোগ নির্ণয়ের জন্য মূলত চৌম্বক অনুরণন প্রতিচ্ছবি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (Magnetic Resonance Imaging MRI) কৌশলটি ব্যবহার করা হয় । কৌশলটি NMR, বিশেষ করে প্রোটন (‘H) NMR, এর মূলনীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস বা প্রোটন নরম কলার অন্যতম উপাদান যা NMR সংকেত প্রদান করে। প্রথমত, মানব শরীরকে শায়িত অবস্থায় একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের (১-৩ টেসলা) মধ্যে প্রবিষ্ট করানো হয়।

বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে প্রোটনগুলোর স্পিন এলোমেলোভাবে (randomly) বিন্যস্ত থাকে। বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে স্পিনগুলো দুটি শক্তিস্তরে বিভক্ত হয়। স্পিনগুলোর এই বিভাজনকে চৌম্বকীকরণ ( magnetization) বলে। চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকের সাথে সমান্তরালভাবে অবস্থিত স্পিনগুলো নিম্ন শক্তিস্তরে, অপরপক্ষে চৌম্বক ক্ষেত্রের বিপরীতমুখী অবস্থিত স্পিনগুলো উচ্চ শক্তিস্তরে অবস্থান করে। স্পিন শক্তিস্তরদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য প্রয়োগকৃত চৌম্বক ক্ষেত্রের মানের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

স্পিনগুলোর শক্তিস্তরে বিভাজন ছাড়াও তারা প্রয়োগকৃত চৌম্বক ক্ষেত্রের মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে স্পিন অক্ষের সাপেক্ষে আবর্তিত হতে থাকে যাকে লারমোর (Larmour) ফ্রিকোয়েন্সি বলে। এখন রোগীর যে অংশের প্রতিচ্ছবি উৎপন্ন করতে হবে সেটিকে কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত (Slice) করা হয়। এমতাবস্থায়, উক্ত খণ্ডিতাংশের উপর বিভিন্ন দিক হতে চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকের সাথে লম্বালম্বিভাবে ( perpendicularly) লারমোর ফ্রিকোয়েন্সির সমান রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির (radio frequency – RF) বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়।

ফলে নিম্ন শক্তিস্তরের স্পিনগুলো RF হতে শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে উন্নীত হয়। এ অবস্থাকে স্পিন অনুরণন (resonance) বলে। উচ্চ শক্তিস্তরে অবস্থিত স্পিনগুলো বিভিন্নভাবে RF বিকিরণ নির্গত করে নিম্ন শক্তিস্তরে গমন করে বা সাম্যাবস্থায় ফিরে আসে। এ অবস্থাকে স্পিন রিল্যাক্সেশন (relaxation) বলে এবং যে সময়ের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে তাকে রিল্যাক্সেশন সময় (relaxation time) বলে।

রোগ নির্ণয়ে MRI পরীক্ষার মূলনীতি

যেহেতু বিভিন্ন পরিবেশে বা অবস্থায় প্রোটনগুলো বিভিন্ন পরিসরের RF বিকিরণ নির্গত করে, কাজেই কম্পিউটার ও ফোরিয়ার রূপান্তর (Fourier Transform) এর সাহায্যে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সিকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা হয় ও সংকেতরূপে রেকর্ড করা হয়। এভাবে একটি নমুনার অসংখ্য খণ্ডিতাংশের সংকেত এর সমন্বয় ঘটিয়ে নমুনার 2D বা 3D প্রতিচ্ছবি উৎপন্ন করা সম্ভব। রিল্যাক্সেশন সময় ও স্পিন ঘনত্ব (spin density) এর মান কোনো নির্দিষ্ট টিস্যুর একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্ম যা সংকেত রূপে গ্রহণ করে নমুনার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি উৎপন্ন করা হয়। সাধারণত টিউমারের ক্ষেত্রে উক্ত মানগুলো সাধারণ টিস্যুর তুলনায় অনেক বেশি পর্যবেক্ষিত হয়।

 

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMO2Dtgsw-p7NAw?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en

 

 

আরও পড়ুন…

Leave a Comment