প্রিজার্ভেটিভস ও এর খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল

প্রিজার্ভেটিভস ও এর খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র” এর  “কর্মমুখী রসায়ন” ইউনিট ৭ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

প্রিজার্ভেটিভস ও এর খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল

অনুমোদিত প্রিজারভেটিভস এর খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল (Permitted Preservatives and Food Preservation Technique)

দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এর সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হয় তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা গেলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি তেমন সুফল বয়ে আনতে পারবে না। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের পাশাপাশি একে সঠিকভাবে প্রিজারভেটিভস এর মাধ্যমে খাদ্য গুণাগুণ সঠিকভাবে বজায় রেখে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রায় সব খাদ্যই বেশি দিন ঘরে রাখা যায় না। প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন এনজাইমের উপস্থিতিতে এসব খাদ্যদ্রব্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যকে এসব পচনের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রিজারভেটিভস এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়।

প্রিজারভেটিভস এর মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিমান ঠিক রেখে খাদ্যকে বহুদিন সংরক্ষণ করা যায়। অর্থাৎ যেসব পদার্থ খাদ্যের সাথে পরিমিত পরিমাণে মিশিয়ে খাদ্যকে বিভিন্ন অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া, ঈস্ট) এর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা হয় তাদেরকে প্রিজারভেটিভস বলে ।

প্রিজারভেটিভসকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে । যথা—

(ক) প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল ফুড প্রিজারভেটিভস এবং

(খ) কৃত্রিম বা রাসায়নিক ফুড প্রিজারভেটিভস।

(ক) প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল ফুড প্রিজারভেটিভস : খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত যেসব পদার্থ ব্যবহৃত হয় তাদেরকে প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল ফুড প্রিজারভেটিভস বলে। যেমন- অ্যালকোহল, ভিনেগার, লবণ, চিনি প্রভৃতি। এগুলোকে বাসাবাড়িতে জ্যাম, জেলি, আচার, সস, জুস ইত্যাদির সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও হিমায়ন, তাপ প্রয়োগ, ধোঁয়া প্রদান এবং সল্টিংকে প্রাকৃতিক খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় ।

i) অ্যালকোহল : মিথানল, ইথানল, প্রোপানল প্রভৃতি অ্যালকোহল। এই অ্যালকোহলগুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ ইথাইল অ্যালকোহল প্রিজারভেটিভস হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। কারণ এই অ্যালকোহলটি সংরক্ষিত খাবারের গুণাগুণ ঠিক রেখে সব ধরনের অণুজীব ধ্বংস করতে পারে। এছাড়া অণুজীবের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার রোধ করতে পারে কারণ অ্যালকোহলগুলো পানিতে দ্রবণীয় । তবে মিথানল বিষাক্ত হওয়ায় একে প্রিজারভেটিভস হিসেবে ব্যবহার করা হয় না।

ii) ভিনেগার : প্রাকৃতিক খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে ভিনেগার অতুলনীয় । ইথানোয়িক এসিড বা অ্যাসিটিক এসিড (CH3-COOH) এর 6 –10% জলীয় দ্রবণকে ভিনেগার বলে। এর আরেক নাম সিরকা। এটি বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভস। এটি বাজারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় ও দামে সস্তা এবং অতিসহজে পানিতে দ্রবীভূত হয়। তা ছাড়াও এর তেমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এটি যেভাবে কাজ করে তা হলো খাদ্যদ্রব্যে প্রিজারভেটিভস হিসেবে একে ব্যবহার করলে খাদ্যদ্রব্যের pH এর মান কমিয়ে দেয়। এ মান 5 থেকে 4 এর মধ্যে নেমে আসে। তখন অণুজীবগুলো আর বংশ বিস্তার করতে পারে না। যেমন, অধিকাংশ অণুজীবের বংশ বিস্তারের অনুকূল pH এর মান 6-5-7.5 এর মধ্যে। তাই প্রাকৃতিক খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগারের কোনো তুলনা হয় না এবং এটি বহুল প্রচলিত।

ভিনেগারের ব্যাপক ব্যবহারের কারণ—

১. মাত্র ৬% ইথানোয়িক এসিডের জলীয় দ্রবণ হওয়ায় এর কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।

২. যদিও ভিনেগার এসিডের দ্রবণ কিন্তু খাদ্যের সাথে এটি গ্রহণে পেটে এসিডিটির কোনো সমস্যা হয় না।

৩. ভিনেগার ব্যবহারে খাদ্য দ্রব্য দীর্ঘ সময় টাটকা থাকে ।

৪. পানিতে অতি সহজেই যেকোনো অনুপাতে মিশ্রণীয়।

৫. দামে সস্তা এবং সহজেই সংগ্রহ করা যায় ।

iii) খাদ্য লবণ : প্রাকৃতিক খাদ্য সংরক্ষণে খাদ্য লবণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্রিজ আবিষ্কারের পূর্বে এটি বহুল প্রচলিত ছিল। খাদ্যদ্রব্যকে খাবার লবণ দ্বারা সংরক্ষণ করার পদ্ধতিকে কিউরিং বলে। এ পদ্ধতিতে মাছ, মাংস, ফল ও শাকসবজিকেও সংরক্ষণ করা যায় ।

এটি যেভাবে কাজ করে তা হলো— যে পাত্রে মাছকে সংরক্ষণ করতে হবে ঐ পাত্রের মধ্যে সঠিক পরিমাণে খাদ্য লবণকে ছিটিয়ে দিয়ে মাছকে পর পর সাজানো হয়। প্রতিটি সারির উপরে নতুন করে খাবার লবণকে ভালোমতো ছড়িয়ে পর পর সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। পাত্রের উপর কিছু অংশ খালি রেখে পাত্রকে ঢাকনা দ্বারা ঢেকে রাখা হয়।

কয়েক দিন পর পর ঢাকনা খুলে সংরক্ষিত মাছ ঠিক আছে কি না তা দেখা হয়। একই প্রক্রিয়ায় মাছকে টুকরা টুকরা করেও সংরক্ষণ করা যায়। তবে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য লবণের সাথে সামান্য পরিমাণে ল্যাকটিক এসিড যোগ করা হয়। কারণ ল্যাকটিক এসিড অণুজীবগুলোকে বংশ বিস্তার করতে বাধা দেয়, ফলে দীর্ঘ দিন সংরক্ষিত থাকে। একই প্রক্রিয়ায় কাঁচা মাংসকেও সংরক্ষণ করা যায়।

iv) চিনি : চিনি একটি অতি পরিচিত সংরক্ষক। বাসায় যে ফল, আচার, জেলি প্রভৃতি তৈরি করা হয় তাতে লবণের পাশাপাশি চিনির দ্রবণও যোগ করা হয়। চিনি আচারের টকের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি প্রিজারভেটিভস হিসেবে কাজ করে। চিনির দ্রবণে অণুজীবগুলো বংশ বিস্তার করতে পারে না। ফলে খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘদিন গুণে, মানে এবং পুষ্টিতে অক্ষুণ্ণ থাকে ।

 

খ) কৃত্রিম বা রাসায়নিক ফুড প্রিজারভেটিভস : খাদ্য সংরক্ষণে যেসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয় তাদেরকে কৃত্রিম বা রাসায়নিক ফুড প্রিজারভেটিভস বলে। খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে এদের চাহিদা ও ব্যাপকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ এরা খাদ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে খাদ্য সংরক্ষণের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দেয় এবং খাদ্যের অণুজীব কার্যকরীভাবে ধ্বংস করে ফেলে। কৃত্রিম খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে সোডিয়াম বেনজোয়েট ও বেনজোয়িক এসিড, সোডিয়াম নাইট্রাইট, সরবেট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এছাড়াও কৃত্রিম খাদ্য সংরক্ষক তিন ধরনের রয়েছে। যথা : (i) এন্টিঅক্সিডেন্ট এজেন্ট, (ii) এন্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট এবং (iii) কিলেটিং এজেন্ট।

(i) এন্টিঅক্সিডেন্ট এজেন্ট : এসব কৃত্রিম খাদ্য সংরক্ষক খাদ্যদ্রব্যকে জারিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে এবং সেই সাথে খাদ্যকে তার কালো দাগ সৃষ্টি হতে রক্ষা করে। এন্টি অক্সিডেন্ট এজেন্ট হিসেবে সাধারণত BHT, BHA, TBHQ, সালফাইট, ভিটামিন ই, ভিটামিন সি ব্যবহার করা হয়। BHT, BHA, TBHQ, এসব কৃত্রিম খাদ্য সংরক্ষক নিরাপদ খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে পরিচিত। সাধারণত তেল ও চর্বিযুক্ত খাদ্য সংরক্ষণে এসব সংরক্ষক ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সালফাইট জাতীয় খাদ্য সংরক্ষক খাদ্যদ্রব্যকে জারিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এসব সংরক্ষক খাদ্যের মানকে ঠিক রেখে খাদ্যকে বহুদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে ।

বিভিন্ন প্রিজারভেটিভস, আক্রান্ত অণুজীব, ব্যবহারের সর্বোচ্চ মাত্রা, খাদ্যদ্রব্য, কার্যক্রম ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ছক

খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল

(গ) কিলেটিং এজেন্ট : খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে কিলেটিং এজেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাইট্রিক এসিড, ল্যাকটিক এসিড, EDTA প্রভৃতি কিলেটিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। নিচের ছকে ছত্রাকনাশক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সংরক্ষক, খাদ্যে তাদের সর্বোচ্চমাত্রা, আক্রান্ত অণুজীব ও সংরক্ষিত খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো :

সালফার ডাইঅক্সাইড এর খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল :

আঙ্গুর প্রয়োগকৃত ফল আপেল, আনারস, নাশপাতি । সাইট্রাস ফল । কলা, পেঁপে, আম, আপেল, চেরি, আনারস, নাশপাতি । আনারস, আপেল, সাইট্রাস ফল । সালফার ডাইঅক্সাইড মূলত ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং এনজাইমের ক্রিয়া প্রতিরোধ করে। হালকা বর্ণের ফল ও সবজির বর্ণ বিপর্যয় কমাতে SO, জারণ রোধক (Antioxident) হিসেবে কাজ করে। যার জন্য খাদ্যে এসকরবিক এসিড, ক্যারোটিন এবং অন্যান্য জারণ যোগ্য যৌগ ধারণ করতে সাহায্য করে।

সালফার ডাইঅক্সাইড সাধারণত তার সালফাইট, বাই সালফাইট এবং মেটাসালফাইট লবণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মদে আকাঙ্ক্ষিত ঈস্টের জন্ম বা বৃদ্ধিতে বাধা দেয় কিন্তু ব্যাকটেরিয়াল কোষের সাথে বিক্রিয়া করে ধ্বংস করে এবং বংশ বিস্তার প্রতিহত করে। এজন্যই মদ তৈরিতে সালফাইট ব্যবহৃত হয় । তবে ভিটামিন B, (থায়ামিন) সমৃদ্ধ খাদ্যে সালফাইটের ব্যবহারে তা নষ্ট হয় বলে ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। টিনজাতকৃত খাদ্যে SO2 ব্যবহার করলে H2S উৎপন্ন হয়ে কটু গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে ।

SO, ব্যবহারের সুবিধাসমূহ :

(ক) ব্যাকটেরিয়াঘটিত গাঁজন রোধে এটা সোডিয়াম বেনজোয়েট অপেক্ষা ভালো কাজ করে ।

(খ) সোডিয়াম বেনজোয়েট অপেক্ষা বেভারেজ পানীয় রং দীর্ঘদিন ধারণ করে ।

(গ) এটা গ্যাস হওয়ায় ফলের রসের পৃষ্ঠতলকেও রক্ষা করে ।

(ঘ) এটা সোডিয়াম বেনজোয়েট অপেক্ষা পানিতে অধিক দ্রবণীয় হওয়ায় ফলের জুস ও স্কোয়াসের সাথে ভালোভাবে মিশে এবং তাদের সংরক্ষণ করে ।

(ঙ) 71°C তাপমাত্রায় বা বায়ু চালনা করে অথবা জুস পাত্র বায়ুশূন্য করে অতিরিক্ত SO2 গ্যাস সহজেই দূর করা যায় ।

SO2 ব্যবহারের অসুবিধাসমূহ :

(ক) বরই, স্ট্রবেরি, আঙ্গুর ইত্যাদি প্রাকৃতিক রঙিন ফল বা ফলের রস সংরক্ষণে SO2 গ্যাস ব্যবহার করা যায় না। কারণ SO, কিছুটা বিবর্ণকারী (bleaching agent)।

(খ) কনটেইনারের টিনের সাথে বিক্রিয়ায় ফিনোলস H2S উৎপন্ন করে যার কটু গন্ধ আছে এবং টিনের আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রন সালফাইট (কালো যৌগ) উৎপন্ন করে যা প্রত্যাশিত নয় ।

SO2 + 2H2O → H2SO4 + 2[H]

রঙিন বস্তু + [H] → বর্ণহীন বস্তু

 

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMO2Dtgsw-p7NAw?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en

 

 

আরও পড়ুন…

 

Leave a Comment